আজ থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগে জন্ম নিয়েছিল পৃথিবী। অবশ্য আজকের মতো চেহারা ছিল না তার। তখন নীলগ্রহ জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। তারপর ক্রমশ উষ্ণতা হারিয়ে শীতল হয়েছে পৃথিবী। জমাট বেঁধেছে উপরের স্তর। নদী, হিমবাহের উৎপত্তি এরও বহু পরে। কিন্তু কতদিন আগে জন্ম হয়েছিল তাদের? কেমনই বা ছিল তাদের চরিত্র? সম্প্রতি, দুই ভারতীয় গবেষকের গবেষণাই পথ দেখাল সেই রহস্য সমাধানের।
“আজ থেকে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগেও স্থিতিশীল মহাদেশ ছিল পৃথিবীর বুকে। নদী, হিমবাহ, সমুদ্র এবং মরুভূমি ছিল অতীতেও। আজকের মতোই নদী কিংবা বায়ুপ্রবাহের কারণে পাথরের ক্ষয় হত সেই সময়। একইভাবে চলত পলি পরিবহন এবং অবক্ষেপণের প্রক্রিয়াও।”
বলছিলেন ওমানের জার্মান ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির ভূতত্ত্বের অধ্যাপক এবং গবেষক ডঃ রজত মজুমদার (Dr. Rajat Majumder)। সাড়ে ৩৫০ কোটি বছর পুরনো নদীর কথা শুনে আশ্চর্য লাগছে নিশ্চয়ই? অস্বাভাবিক নয়। গোটা বিশ্বের তাবড় ভূতাত্ত্বিকদের একাংশও অবিশ্বাস করেছিলেন এই দাবিকে। কিন্তু বিষয়টা ভিত্তিহীন নয় মোটেই। কেননা ভারতের বুকেই লুকিয়ে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন পাললিক শিলার নিদর্শন (Old Sedimentary Rock)। যার বয়স কমপক্ষে ৩৪০ কোটি বছর।
বছর কয়েক আগের কথা। ওড়িশার কেওনঝড় এলাকায় প্রাচীন শিলার অনুসন্ধানে অভিযানে নেমেছিলেন ডঃ মজুমদার এবং কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের ও সিআইএসআর-এর গবেষিকা ডঃ ত্রিস্রোতা চৌধুরী (Trisrota Chowdhury)। সেসময় ৪২৪ কোটি বছরের পুরনো আগ্নেয়শিলা থেকে ‘প্রাচীনতম খনিজ’ জারকন খুঁজে পান তাঁরা। সেইসঙ্গে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বেশ কিছু পাললিক শিলার স্তরও। নিশ্চিতভাবে সেই পাললিক প্রস্তুরখণ্ডের বয়স নির্ণয়টাই ছিল সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। এবার আনুষঙ্গিক প্রমাণের নিরিখেই দুই বাঙালি গবেষক জোরালো দাবি করলেন, ওড়িশার বুকে খুঁজে পাওয়া সেই পাথরের বয়স ন্যূনতম ৩৪০ কোটি বছর। কিন্তু কীভাবে?
আরও পড়ুন
ঘনকাকার একক দিয়েই তৈরি পৃথিবী, প্লেটোর মতকে সমর্থন জানালেন ভূতাত্ত্বিকরা
আরও পড়ুন
পৃথিবীর ‘শৈশব’ রয়েছে ভারতেই, প্রাচীনতম শিলা আবিষ্কার বাঙালি ভূতাত্ত্বিকের
“যখনই কোনো নদী প্রবাহিত হয়, তখন তার উপত্যকায় পলির আস্তরণ পরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থেকে তার স্তর। ফলত, উপরের শিলাস্তর স্বাভাবিক নিয়মেই নিচের শিলাস্তরের থেকে নবীনতর বলে ধরে নেওয়া চলে। কেওনঝড়ে আমরা যে পাললিক শিলার অস্তিত্ব খুঁজে পাই, সেটি আচ্ছাদিত ছিল পশ্চিম আয়রন ওর-গ্রুপের লৌহ আকরিক সমৃদ্ধ বিশেষ এক ধরনের শিলার তলায়। যা মূলত আগ্নেয়গিরির ছাই থেকে সৃষ্ট। আগ্নেয়গিরিজাত ওই শিলার বয়স ৩৪০ কোটি বছর। কাজেই একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই পাললিক শিলাটির বয়স তারও বেশি”, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করলেন ডঃ মজুমদার।
আরও পড়ুন
হিমালয়ের জায়গায় সমুদ্র; তালপাতার জীবাশ্ম আবিষ্কার ভারতীয় ভূতাত্ত্বিকের
প্রাথমিকভাবে দুই বাঙালি গবেষকের এই দাবিকে অস্বীকার করেছিলেন অনেকেই। আর তার অন্যতম কারণ হল, পাললিক শিলার বয়স নির্ণয়ের জন্য ভারতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের অভাব। যে কারণে এখনও নিশ্চিত করে জানানো সম্ভব হয়ে উঠছে না কেওনঝড়ের ওই প্রাচীন পলিপাথরের বয়স। তবে এবার এই গবেষণাকে স্বীকৃতি জানিয়েছে বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞান জার্নাল ‘প্রিক্যামব্রিয়ান রিসার্চ’। সম্প্রতি, সেখানেই প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য এই গবেষণাপত্রটি। যা শুধু প্রাচীনকালের স্থিতিশীল মহাদেশীয় পরিবেশের অস্তিত্বের কথাই জানায় না। বরং, উস্কে দেয় আরও বেশ কিছু ভূতাত্ত্বিক রহস্যকেও। ঠিক কীরকম?
বছর চারেক আগে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার নর্থ পোল ডোম অঞ্চলে একদল অস্ট্রেলিয়ান গবেষক অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাচীন পাললিক শিলার অস্তিত্ব খুঁজে পান। প্রমাণ দেন অধুনা নিউজিল্যান্ডের উষ্ণ প্রস্রবনের মতো পরিবেশেই প্রথম জন্ম নিয়েছিল প্রাণ। হ্যাঁ, এই দাবি চমকে ওঠার মতোই। মহাসাগরীয় নয়, বরং প্রথম জীব নাকি জন্মেছিল মহাদেশীয় অঞ্চলে। যদিও পরবর্তীতে তাঁদের সেই গবেষণা সমালোচিত হয়েছে কঠোরভাবে। ডঃ মজুমদার এবং ডঃ চৌধুরীর সাম্প্রতিক আবিষ্কার যেন সেই দাবির পক্ষেই। প্রাচীন সময়ে নদীপ্রবাহের অস্তিত্ব থাকলে স্থলজ পরিবেশে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না একেবারেই। ডঃ মজুমদার জানালেন, “তবে নিশ্চিতভাবে এটা বলা বেশ কঠিন। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই এখনও। এমনটাও হতে পারে সমুদ্র এবং স্থলজ পরিবেশের সংযোগস্থলেই গড়ে উঠেছিল প্রাণীজ পরিমণ্ডল।”
এখানেই শেষ নয়। আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আর তা হল, পাললিক শিলার ওপর আগ্নেয় শিলাস্তরের অস্তিত্ব। শিলাস্তরের এই গঠন আমাদের এনে হাজির করে আরও এক ভূতাত্ত্বিক ধাঁধাঁর সামনে। তবে কি প্রাচীন পৃথিবীর স্থিতিশীল পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল টেকটোনিক পাতের চলাচলের কারণে? হ্যাঁ, উঠে আসছে সেই সম্ভাবনাও। ডঃ মজুমদারের কথায়, “জন্মলগ্ন থেকে ক্রমাগত চরিত্র বদল করে চলেছে পৃথিবী। ফলত, এমনটা হতেই পারে সেইসময় পৃথক পৃথক মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছে সংযুক্ত মহাদেশ বা গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের মতো সংযুক্ত মহাদেশ। তারপর আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তারা।”
সাম্প্রতিক সময়ে মঙ্গল এবং সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলির ইতিহাস সন্ধানে একজোট হয়ে নেমেছে নাসা, ইসরো, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মতো মহাকাশ সংস্থাগুলি। পৃথিবীর আদি ইতিহাসের সমাধান মিললে সেই কাজও অনেকক্ষেত্রে সহজতর হয়ে যাবে বলেই আশাবাদী বাঙালি গবেষকদ্বয়। একটা সময় বিশ্বের তাবড় ভূতাত্ত্বিকরা মনে করতেন কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলিতেই এই ধরনের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এবার সেই তালিকায় জুড়ল ভারতের নামও। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, সিংভূম অঞ্চলে সঠিকভাবে অনুসন্ধান চালালে বহু অজানা রহস্যের সমাধান মিলবে বলেই মনে করছেন ডঃ চৌধুরী এবং ডঃ মজুমদার।
তবে তার জন্য অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। “অস্ট্রেলিয়ায় এই ধরনের সাইটে গবেষণার জন্য খনন করতে গেলেও সরকারের অনুমতি নিতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে ভারতের ওড়িশা, সিংভূমের মতো ইতিহাস সমৃদ্ধ অঞ্চলে অবাধেই চলছে স্থাপত্য নির্মাণের জন্য পাথর খাদান। উপযুক্ত সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে, হাত ছাড়া হয়ে যাবে অসংখ্য প্রমাণ”, জানালেন ডঃ মজুমদার। সেইসঙ্গে দেশের গবেষণা পদ্ধতিতেও প্রযুক্তিগত বদল আনার আর্জি জানালেন তিনি। তবে সেই সুদিন আসতে খুব বেশি দেরি নেই। দুই বাঙালি গবেষকের আবিষ্কারই ভারতের সম্পর্কে ধারণা বদলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণামহলে। জার্মানি, ব্রিটেনের মতো একাধিক দেশের গবেষকরা এখন আগ্রহী ইতিহাস-সমৃদ্ধ সিংভূমে গবেষণামূলক অনুসন্ধান চালানোর জন্য। ফলত, আগামীদিনে ভারতের বুকে পৃথিবীর বিবর্তন সম্পর্কিত জটিল ধাঁধাঁর সমাধান মিললে, আশ্চর্য হওয়ার নেই কিছু…
Powered by Froala Editor