ষাটের দশকের শেষের দিক সেটা। একটা উত্তাল সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তখনও অবশ্য জন্ম নেয়নি বাংলাদেশ। পূর্ব-পাকিস্তানই তার পরিচিতি। সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেই একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান বাংলা সাহিত্য একাডেমিতে। ভিড় করেছেন হাজার হাজার মানুষ। সেই ভিড়ের মধ্যেই হাতে পুস্তিকা নিয়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছেন বছর কুড়ির এক তরুণ। প্রচ্ছদে ছাপা ‘একুশের সংকলন’। পেট-রোগা সেই পত্রিকার ভেতরে ভরা আগ্নেয় অক্ষর, বিপ্লবের বার্তা। আর সেই যুবকের চোখে দিন বদলের স্বপ্ন…
হাবীবুল্লাহ সিরাজী। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের অস্থিতিশীল এমনই এক পরিস্থিতিতে কবিতাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বন্দুকের বদলে কলমই হয়ে উঠেছিল নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁর অস্ত্র। গতকাল রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। কিছুদিন আগেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। তবে এবার আর লড়াই জারি রাখতে পারলেন না তিনি। ৭৩ বছর বয়সেই জীবনচরিতে ইতি টানলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি তথা বাংলা সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। পরবর্তীকালে পড়াশোনার সূত্রে ঢাকায় আসা। জড়িয়ে পড়া রাজনীতির সঙ্গে। প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র হলেও কবিতাকে বেছে নেওয়া দিন বদলের স্বপ্ন থেকেই। কিংবা কবিতাই বেছে নিয়েছিল তাঁকে। স্বাধীনতার পর পেশাগত কারণে অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন দেশের বাইরে। কাজ করেছেন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া-সহ একাধিক দেশে। তবে বাংলা ভাষার সঙ্গে ছিন্ন হয় যোগাযোগ। প্রকৌশলী জীবনের মাঝেই নিজের মতো পথ খুঁজে নিয়েছিল কবিতা।
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’। অবশ্য এই গ্রন্থের প্রেক্ষাপট, প্রতিটি কবিতাই নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনোত্তর সময়েই। পরবর্তীকালেও বার বার তাঁর লেখায় ধরা দিয়েছে সমসাময়িকতা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর কবিতা এক কথায় পরিবর্তনশীল সময়ের ডায়েরি। শুধু বদলে তার ভাষা, তার গঠন। বার বার ছক ভেঙে নতুন করে কবিতাকে খুঁজেছেন তিনি। অনুরণিত হয়েছে সচেতন শব্দপ্রয়োগ, উপমা, অলংকার। আবার কখনো তাঁর কাব্যের প্রেক্ষাপট হয়ে উঠেছে পৌরাণিক ঘটনা। লেখার মধ্যে দিয়েই তিনি বিঁধেছেন ধর্মান্ধতাকে। নীরবেই তিনি দিক বদলে দিয়েছেন পূর্ববঙ্গের সাহিত্যচর্চার। কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন সিরাজী। সব মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা ৬৫টিরও বেশি।
আরও পড়ুন
স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করায় কবিকে নির্মম হত্যা মায়ানমারে
১৯৯১ সালে বাংলা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান সিরাজী। ২০০৭ সালে পান বিষ্ণু দে পুরস্কার। তাছাড়াও রূপসী বাংলা পুরস্কার, কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক-সহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
আরও পড়ুন
বন্ধুর অহংকার ভাঙাতেই প্রথম কবিতা লেখেন শিবনাথ শাস্ত্রী
২০১৮ সালে বাংলা সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব নেন তিনি। ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতিও। আশির দশক থেকেই এই সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন তিনি। সম্প্রতি মুজিব শতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে একশোটি নতুন বইয়ের সম্পাদনা করে বাংলা সাহিত্য একাডেমি। সেই উদ্যোগের অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন হাবীবুল্লাহ সিরাজীই।
আরও পড়ুন
কলকাতায় এলেন গালিব, তর্কে জড়ালেন অন্যান্য কবিদের সঙ্গেও
গত এপ্রিল মাসেই শেষ হয়েছে বাংলাদেশের একুশে বইমেলা। তার মাস দেড়েকের মধ্যেই যে তিনি বিদায় নেবেন, কে-ই বা অনুমান করতে পেরেছিল! এক অশান্ত সময়েই বাংলার সাহিত্যজগতে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। আরও এক অস্থিরতার মধ্যেই প্রস্থান করলেন তিনি। শুধু জিইয়ে রাখলেন দিনবদলের স্বপ্ন। এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রস্থানে শোকস্তব্ধ বাংলাদেশের সাহিত্যমহল।
Powered by Froala Editor