সাল ১৯৪৬। স্বাধীনতা আসতে তখনও একটি বছর দেরি। নানা স্বপ্ন ভারতবাসীর চোখে। গলির মোড়ের প্রতিটা চায়ের দোকান থেকে শ্মশানের ডোম, আপিসের বড়োবাবু— ঘুম ভেঙে গেছে প্রত্যেকের। নতুন দেশ, স্বাধীন দেশ, দু’শো বছরের শিকল থেকে বরাবরের মতো মুক্তি! কিন্তু স্বপ্নের উল্টোদিকের বাস্তবটা কি সত্যিই তেমনটা হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্য তিরিশের যুবক। শব্দ, ছন্দ, কবিতাকেই জীবনের পথ জেনেছেন। কিন্তু সেটাই কি সব? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এর থেকেও অনেকটা বিস্তৃত ছিল জীবন। ঐ সময় দাঁড়িয়ে যে বইটা ছাপিয়েছিলেন, তার প্রচ্ছদে মিলেমিশে গিয়েছিল জাতীয় পতাকা। জাতীয় পতাকা— একটা স্বপ্ন, অজস্র সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, তাঁদের জীবন আর পতন…
বাংলা কবিতার জগতে কত কবির মৃত্যুদৃশ্য উঠে এসেছে! রবীন্দ্রনাথের ভিড়ে মিশে যাওয়া, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্তব্ধতা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর জীবনানন্দ দাশের দৈন্য বা শম্ভু রক্ষিতের ‘মহাপৃথিবী’র দিকে নির্জন যাত্রা— আরও কত কী। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুমিছিল ছিল কবিতা আর গানে মোড়া। প্রতিটা শব্দ মানুষের কাছাকাছি, মাটির কাছাকাছি। মানুষের রক্ত লেগে আছে প্রতিটা শব্দে। ‘আমার মা যখন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছো’… সহজ কথাই চাবুক হয়ে ওঠে! একটা সময় প্রেমের দিকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন বয়সগুণে। কোনো এক অজানা প্রেয়সীকে দেখতে চেয়েছেন বারবার; তার চেহারা জানতেন কি? নাকি তাকেই খুঁজে চলা বারবার, প্রতি রাত?
স্বাধীনতা এল। সময় এগোতে লাগল আরও। কিন্তু পরবর্তী সময়টা অনেকের কাছে স্বপ্নভঙ্গের। ‘ক্ষুধাতুর শিশু’র দল বসে আছে পথে, বাংলার বুকে শুরু হয়েছে একের পর এক আন্দোলন। খাদ্য আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন, বন্দিমুক্তি আন্দোলনের আগুন জ্বলেছে; অন্যদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের রেশও এসে পড়েছে এখানে। এখনও কি চুপ থাকার সময়? এই দেশ শাসকের একার হতে পারে না। এই ‘রাস্তা কারোর একার নয়’। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলম গর্জে উঠল। তাঁর কাব্যজীবনের দুটি স্তর ভালো বোঝা যায় কবিতার বিষয় দেখলে। প্রেম একসময় বদলে গেছে বিপ্লবে, মানুষের কথায়। মানুষ! মানুষ! এক ও একমাত্র সার সত্য এই পৃথিবীর। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই হয়ে উঠলেন একটা ধারা। নিজের জীবনে কোনো চাকরিতে বেশি থিতু হতে পারেননি। কিন্তু নিজের আদর্শের মাটি সবসময় আঁকড়ে ধরেছিলেন। জীবনে কোনদিনও কোনো সরকারের থেকে সাহায্য নেননি। কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী থাকলেও সক্রিয়ভাবে দলীয় রাজনীতি করেননি কখনও। একটাই কথা ছিল তাঁর, কমিটেড হতে গেলে কোনো দলে কেন নাম লেখাতে হবে…
মেলায় মেলায় ঘুরে নিজেই নিজের বই বিক্রি করতেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কাঁধের ঝোলায় রাখা থাকত সেসব বই। অন্য কারোর বই ভালো লাগলে সেগুলোও বিক্রি করতেন। দরজায় দরজায়ও ঘুরেছেন একটা সময়। এভাবেই মানুষের মধ্যে মিশে যেতেন তিনি। এভাবেই মানুষের ভাষা তাঁর নিজেরও ভাষা হয়ে উঠত। ষাট-সত্তর দশকের বাংলায় যখন আগুন জ্বলছে, তখন তাঁর সমসাময়িক কবিরা নিরাপদে জীবন কাটাচ্ছেন। না, এসব কখনই সহ্য হত না বীরেন্দ্র-র। তিনিই তো দেখেছিলেন সেই ‘একাকী যুবতী চাঁদ’-কে, যে ‘মাঝরাতে ফাঁকা ট্রেনে চুরি করে দুর্ভিক্ষের চাল।’ জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার নিষিদ্ধ করেছিল তাঁর কবিতা। ভয়, সরকারের মনে তাঁর লেখা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। কীসের ভয়? মুক্তমঞ্চের! আর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিদের কবিতা সেই মুক্তমঞ্চেরই জয়গান গায়। মানুষের চোখে তুলে ধরে সত্যের আয়না…
আরও পড়ুন
‘ঢের হয়েছে’, মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন সমর সেন
মৃত্যুর এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে একটি কবিতাপাঠের আসরে গেছেন কবি। ছোটো ছোটো নানা জায়গায় তখন যাচ্ছেন তিনি। সেরকমই এক জায়গায় ‘প্রভাস’ কবিতাটি শুনতে চান একজন। পাঠ করার আগে একটু সতর্ক করে দিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কেন? না, এই কবিতাটি ‘প্রগতিশীলদের তেমন পছন্দ নয়।’ তাঁর প্রতিটা শব্দ দিনের শেষে নিজেদের দিকে, সমাজের দিকে ফিরে চাওয়া। একটু একটু করে পর্দা সরিয়ে দেখা সবকিছু। আগুন, ঝড়, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁদের হয়েই পতাকা উড়িয়েছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মাথা উঁচু রাখাই যে নিয়ম! সবাই যেখানে আখের গোছাতে ব্যস্ত, সেখানে কেউ তো আসুক মানুষ হয়ে। মানুষের পাশে। কেবল শব্দে নয়; জীবনেও…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কবিসম্মেলনে ডাক পান না গীতিকাররা, আক্ষেপ করতেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার