আশির দশকের কথা। শান্তিনিকেতনের আনাচে কানাচে তখন ছুটে আসছেন দেশ-বিদেশের বিদ্বজনেরা। সেখানেই হাজির হয়েছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রতিনিধি। তখন তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন; কিন্তু মস্তিস্ক একইরকম সচল। খবর পেলেন, মেলবোর্ন থেকে এক বাঙালি অধ্যাপকও হাজির হয়েছেন শান্তিনিকেতনে। তাড়াতাড়ি ডেকে পাঠালেন আইয়ুব সাহেব। ওঁর সঙ্গে কথা বলেও যে আনন্দ। অনেকক্ষণ ধরে দুজনের আলাপ-আলোচনা চলল। শেষে যখন বাঙালি অধ্যাপকটি ফিরে আসছেন, তখনই তাঁর হাত ধরে ফেললেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। আপনি দেশে ফিরে আসুন, এই বাংলার আপনাকে খুব দরকার। এমন কাতর আর্তি উপেক্ষা করতে পারেননি সেদিনের সেই বাঙালি অধ্যাপক, শিবনারায়ণ রায়। বিদেশের বৈভব ছুঁড়ে ফেলে চলে এসেছিলেন নিজের মাটির কাছে…
আমরা ঠিক কতজন শিবনারায়ণ রায়কে চিনি, তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ। অনেকে হয়তো পড়াশোনার সুবাদে তাঁর নামটুকু শুনেছি, কেউ কেউ গভীরভাবে তাঁকে নিরীক্ষণ করেছেন। আর অনেকেই হয়তো শোনেননি। অবশ্য তিনি সেসবের পরোয়াও করেননি কোনদিন। এই ২০২১-এ তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। কিন্তু একপ্রকার নীরবেই সেই রাস্তা পেরোচ্ছেন শিবনারায়ণ রায়। নিজে জীবিত না থাকলেও এখনও আলো দিয়ে যাচ্ছেন বাংলার অন্যতম প্রধান এই রেনেসাঁ-পুরুষ…
পারিবারিক দিক থেকেও শিক্ষা ও পড়াশোনার উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন শিবনারায়ণ। বাবা উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ শাস্ত্রী এবং মা রাজকুমারী রায় দুজনেই ছিলেন যথেষ্ট বিদ্বান। রাজকুমারী দেবী নিজেও একজন লেখিকা ছিলেন। নিয়মিত কবিতা লিখতেন বামাবোধিনী, শিবম, মহিলার মতো পত্রিকাগুলোতে। প্রথম জীবনে বোধহয় মায়ের প্রভাবেই কবিতা লেখা শুরু শিবনারায়ণের। এবং ধীরে ধীরে ভাষা, দর্শন ও চিন্তার সঙ্গে দিনযাপন। পড়াশোনায় বরাবরের মেধাবী ছাত্রটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিনা গুহ স্বর্ণপদকও পান…
২০০৮ সালে যখন প্রয়াত হলেন, তখন দুই বাংলাই মুষড়ে পড়েছিল। বলা হয়েছিল, বাংলার চিন্তাভাবনার রেনেসাঁ যারা এনেছিলেন, তাঁদের অন্যতম প্রতিনিধি চলে গেলেন। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল ঋত্বিক ঘটকের বহু প্রচলিত একটি কথা— ‘ভাবো। ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।’ ঠিক এই কথাটাই সারাজীবন ধরে বলে এসেছেন শিবনারায়ণ রায়ও। ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে, সেইসঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে প্রচুর। তাহলেই সবটা মিলিয়ে নতুন নতুন পথ হাজির হবে আমাদের সামনে। সিটি কলেজ থেকে মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়, সমস্ত জায়গায় অধ্যাপনার সূত্রে এই বার্তাটিই পৌঁছে দিয়েছেন সবার মধ্যে। এর মধ্যেই ডাক এল সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে। সেখানকার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই শুরু করলেন কাজ। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতেই এই বিভাগটি রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এবং ভারততাত্ত্বিক, চিন্তাবিদ হিসেবে শিবনারায়ণ রায়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা পৃথিবীতে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি জায়গায় গিয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। একজন বাঙালি কীভাবে নিজের মেধার জোরে, চিন্তার জোরে আন্তর্জাতিক নাগরিক হয়ে উঠছেন, শিবনারায়ণবাবুকে দেখলেই বোঝা যায়…
অবশ্য তার আগেই আলাপ হয়ে গিয়েছে বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে। ইতিহাস অবশ্য তাঁকে চেনে এম এন রায় নামে। ধীরে ধীরে আলাপচারিতা গড়ায় মুগ্ধতায়। এম এন রায়ের মতবাদ, ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট হন শিবনারায়ণ। এবং তখনই তাঁর জীবনে আসে র্যা ডিকাল হিউম্যানিজম। না, এই বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য এই প্রতিবেদন নয়। তবে শিবনারায়ণ রায়ের কথা এলে অবশ্যই আসবেন এম এন রায়, এবং তাঁর র্যা ডিকাল হিউম্যানিজমের মতবাদ। এম এন রায়কে নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছিলেন তিনি; পরে সেগুলোই সমাদর পায় গোটা বিশ্বে। এমনকি, মুগ্ধ হন ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রেন্ড রাসেল। তাঁর লেখার প্রশংসা করে রাসেল বলেছিলেন, “আমি মনে করি শিবনারায়ণ রায় এমন একটি স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী যা পৃথিবীর সকল অংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ…”
শিবনারায়ণ রায়কে কেবল বাঙালি বললে খানিক ভুলই হবে। তিনি বিশ্বনাগরিক। বাংলাদেশ তাঁর কাছে একটি দেশ নয়; অবিভক্ত বাংলা প্রদেশই। নিজের বুদ্ধি, এমধা, চিন্তা দিয়ে যেটা ঠিক মনে করতেন, সেটাই করতেন। কখনও অন্য কারোর কথায় প্ররোচিত হননি। আর সেজন্যই বিপদের দিনেও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তসলিমা নাসরিনের। বিভন্ন সাক্ষাৎকারে যতবারই শিবনারায়ণ রায়ের প্রসঙ্গ এসেছে, ততবারই এমনটাই বলেছেন স্বয়ং লেখিকা। চিন্তার চর্চা যে দুই বাংলায় সেরকম হচ্ছে না, তা নিয়ে খেদও শোনা যেত তাঁর মুখে। সেসব দূর করতেই বের করেছিলেন ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকাটি। ১৯৮০ থেকে ২০০২— দীর্ঘ ২২ বছর তিনিই ছিলেন এই পত্রিকার সব। র্যা ডিকাল হিউম্যানিজম নিয়েও তাঁর চিন্তা ও কাজ প্রশংসনীয়। এ হেন মানুষটির আজ জন্মশতবর্ষ পূর্তি হচ্ছে। নীরবে, একা এক স্তব্ধ জগতে…
আরও পড়ুন
সাইকেল নিয়ে বিশ্বভ্রমণ! ৯০ বছর আগে যে বাঙালির স্পর্ধায় অবাক হয়েছিল দুনিয়া
তথ্যসূত্র-
১) ‘ওঁরা আট জন’, তসলিমা নাসরিন, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘শিবনারায়ণ রায় ও তাঁর অনন্ত জিজ্ঞাসা’, কামরুল হাসান, রেডটাইমস
৩) ‘শিবনারায়ণ রায়: বাংলার রেনেসাঁসের সর্বশেষ দীপ’, এমডি সইফুল ইসলাম, আর্টস বিডি নিউস ২৪
Powered by Froala Editor