গণেশ ঘোষ থেকে বাদল সরকার— রাষ্ট্রীয় সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন যে-সমস্ত বাঙালি

/১১

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক মুহূর্তে ঘোষণা করা হল ২০২২ সালের পদ্ম পুরস্কার প্রাপকদের নাম। প্রতি বছরের মতো এবারেও পদ্ম পুরস্কারের তালিকা বাঙালিশূন্য হয়ে থাকেনি। তবে তিনজন বাঙালি প্রাপকের মধ্যে ইতিমধ্যে দুজনই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কেন্দ্র সরকারের এই পুরস্কার নেবেন না। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ লগ্নে এসে এই পুরস্কার ঘোষণা করায় কিছুটা অপমানিতই হয়েছেন তিনি। অন্যদিকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজনৈতিক কারণেই কেন্দ্রের দেওয়া এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এত বড়ো সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া অবশ্য নেহাৎ মুখের কথা নয়। তবে বাঙালির ইতিহাসে তেমন নজিরও খুব কম নয়। আজ রইল তেমনই কিছু বাঙালির কথা, যাঁরা এর আগে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন।

/১১

গণেশ ঘোষ – ১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য বিশেষ তাম্রপত্র প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই তাম্রপত্রের ভিত্তিতেই তাঁদের পেনশনের ব্যবস্থাও করা হয়। সেই তালিকায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক গণেশ ঘোষের নামও ছিল। সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু গণেশ ঘোষ তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। আর তাঁর দল তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ। যে রাষ্ট্র তাঁর দলকে নিষিদ্ধ করেছে, সেই রাষ্ট্রের দেওয়া কোনো সম্মানই গ্রহণ করেননি গণেশ ঘোষ। জানিয়ে দিয়েছিলেন, পেনশনের কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই। প্রয়োজন পড়লে তাঁর দলই তাঁকে দেখবে।

/১১

শিশির কুমার ভাদুড়ী – ভারতের ইতিহাসে প্রথম যে মানুষটি পদ্ম পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিও একজন বাঙালি। নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী। ১৯৫৯ সালে তাঁকে নাট্যজগতে অবদানের জন্য পদ্মভূষণ পুরস্কার দিতে চায় কেন্দ্র। অন্যদিকে নাট্য সংস্কৃতির প্রতি ভারত সরকারের উদাসীনতা নিয়ে তার আগে একাধিকবার সরব হয়েছিলেন নাট্যাচার্য। পদ্মভূষণ পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ঘোষণা করা হলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কয়েকজন নাট্যকর্মীকে বছর বছর পুরস্কৃত করলেই নাট্যসংস্কৃতিকে বাঁচানো যায় না। নাট্যসংস্কৃতির বিষয়ে কেন্দ্র যে ঔদাসীন্য দেখিয়েছে, তার প্রতিবাদেই তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন না।

/১১

মাদার টেরেসা – জন্মসূত্রে বাঙালি না হলেও তিনি বাকিদের চেয়ে কোনো অংশে কম বাঙালি নন। কলকাতা শুধুই তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল না, তিনি কলকাতার স্থায়ী নাগরিকও ছিলেন। ১৯৬০ এবং ১৯৬১ সালে পরপর ২ বছর পদ্মশ্রী পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর যুক্তি ছিল, ঈশ্বরের নির্দেশেই তিনি মানুষের সেবা করছেন। তাই রাষ্ট্রের স্বীকৃতির কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই। অবশ্য ১৯৬২ সালে কলকাতার আর্কবিশপের অনুরোধে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার গ্রহণ করেন। এবং ১৯৮০ সালে তিনি ভারতরত্ন পুরস্কারও পান।

/১১

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় – ১৯৭০ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য ঘোষণা করা হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম। যদিও তিনি আপামর সংস্কৃতি জগতেরই মানুষ ছিলেন, তবে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন তাঁর পুরস্কার না নেওয়ার কারণ রাজনৈতিক। মার্ক্সবাদী আদর্শে বিশ্বাসী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় সম্মান গ্রহণে অসম্মত হয়েছিলেন। অবশ্য ২০০৪ সালে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কার গ্রহণ করেন। তাঁর শুভাকাঙ্খীদের মনে আঘাত দিতে চান না বলেই পুরস্কার গ্রহণ করছেন, এমনটাও জানিয়েছিলেন তিনি।

/১১

বাদল সরকার – বাংলা নাটকের জগতের আরেক দিকপাল বাদল সরকার। ১৯৭২ সালে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয় পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য। অবশ্য এর আগে ১৯৬৮ সালে সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সেই পুরস্কার ছিল কেবল শিল্পীদের জন্যই। আর বাদল সরকার মনে করেছিলেন, শিল্পী জীবনে সেটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এরপর আর কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। এমনকি ২০১০ সালে মৃত্যুপথযাত্রী বাদল সরকারকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দিতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।

/১১

তারাপদ চক্রবর্তী – ১৯৭৪ সালে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীত আচার্য এবং বাচিকশিল্পী তারাপদ চক্রবর্তী পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। অবশ্য তাঁর এই সিদ্ধান্তের কোনো কারণ তিনি জানাননি। ব্যক্তিগত কারণেই পুরস্কার নিতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

/১১

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় – ১৯৮৮ সালে মৃত্যুপথযাত্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে পদ্মশ্রী পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে অসংখ্য সম্মান পেলেও তাঁর জন্য পদ্ম পুরস্কারের কথা আগে কখনও ভাবা হয়নি। জীবনের শেষ লগ্নে এসে এই পুরস্কার ঘোষণায় অপমানিত বোধ করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর তাই সরাসরি সেই সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

/১১

নিখিল চক্রবর্তী – সাংবাদিকতার ইতিহাসে নিখিল চক্রবর্তী এক কিংবদন্তি নাম। জরুরি অবস্থার সময়ে কঠোর রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের মধ্যেও তিনি যেভাবে সত্যনিষ্ঠ খবর সংগ্রহ এবং প্রচার করে গিয়েছেন, তা অবাক করার মতোই। ১৯৯০ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু নিখিল চক্রবর্তী জানান, সাংবাদিকরা কেবলমাত্র মানুষের কাছেই দায়বদ্ধ। কোনো সরকারের কাছে নন। তাই সরকারি খেতাব নেওয়া উচিত নয় কোনো সাংবাদিকেরই। সারা জীবন এই আদর্শে অটল ছিলেন নিখিল চক্রবর্তী।

১০/১১

সুভাষচন্দ্র বসু (মরণোত্তর) – ১৯৯২ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে মরণোত্তর পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়ার কথা জানায় সরকার। যদিও সুভাষ মৃত্যু রহস্যের মীমাংসা আজও হয়নি। মরণোত্তর পুরস্কার গ্রহণ করলে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকেই স্বীকৃতি জানানো হত। তাছাড়া নেতাজির পরিবার জানান, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর্যন্ত যখন নেতাজিকে কোনো বিশেষ সম্মান জানায়নি ভারত সরকার, তখন এতদিন পরেও আর তার প্রয়োজন নেই। তাই ভারত সরকারের পুরস্কার ফিরিয়ে দেন নেতাজির পরিবারের সদস্যরা।

১১/১১

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত – ২০১১ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক তথা কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর দীর্ঘ শিল্পী জীবনের কাছে পদ্মশ্রী পুরস্কার নগণ্য বলে মনে করেছিলেন তিনি। অবশ্য শিল্পীর বক্তব্যকে সম্মান জানিয়েই পরের বছর, ২০১২ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন বুদ্ধদেব।

Powered by Froala Editor

More From Author See More