Powered by Froala Editor
ফিরে দেখা ২০২২ : চলে গেলেন যেসব স্বনামধন্য বাঙালি— পর্ব ২
১/১১
দিন ফুরিয়ে এসেছে ২০২২-এর। দোরগোড়ায় হাজির আরও একটি নতুন বছর। বিগত এক বছরে আমরা যেমন অনেককিছু পেয়েছি, তেমনই দীর্ঘ আমাদের হারানোর তালিকাও। ফিরে দেখা যাক সেইসব কিংবদন্তি বাঙালিদের, বিগত এক বছরে যাঁদের হারিয়েছে আমরা। প্রহরের পাতায় থাকল তাঁদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা।
২/১১
মৃণাল বসু চৌধুরী (২ মার্চ)— সেন্ট্রাল পার্কে বসেছে কলকাতা বইমেলার আসর। আর বইমেলার তৃতীয়দিনেই ভেসে এসেছিল দুঃসংবাদ। ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মৃণাল বসু চৌধুরীর মৃত্যুর খবর। গতানুগতিক সাহিত্যচর্চার ছক ভেঙে কবিতার জগতে নতুন ধারা নিয়ে এসেছিলেন মৃণাল বসু চৌধুরী। বামপন্থী চিন্তাধারা, হাংরি আন্দোলনের বাইরেও সমাজ-সংস্কৃতির একটা বড়ো অংশ রয়েছে— তার ছবিই ধরতে চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র সাহিত্যপত্র ‘শ্রুতি’-তে। আজীবন ভরসা রেখেছিলেন তরুণ কলমে।
৩/১১
পার্থ ঘোষ (৭ মে)— পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষ। এই দুটি নাম বাদ দিলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় বাচিকশিল্পের ইতিহাস। পার্থ-গৌরী দম্পতির উপস্থিত ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ আজও যেকোনো আবৃত্তিপ্রেমীর কাছে মহার্ঘ্য। ২০১৬ সালেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন গৌরী ঘোষ। চলতি বছরের প্রথম অর্ধেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ‘কর্ণ’ পার্থ। তাঁর মৃত্যুতে ইতি পড়ে আকাশবাণীর এক বর্ণময় অধ্যায়ে।
৪/১১
আব্দুল গফফার চৌধুরী (১৯ মে)— ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…’ এপার বাংলাই হোক কি বাংলাদেশ— ভাষা দিবসের দিন বঙ্গভূমের অলিতে গলিতে বেজে ওঠে এই গান। আর এই গানের স্রষ্টা তিনিই। আব্দুল গফফার চৌধুরী। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাক্ষী তিনি। সে-সময় তো বটেই, স্বাধীনতার পরও রাজনীতি সহ একাধিক বিষয়ে নিয়মিত লেখালিখি করেছেন বাংলাদেশের একাধিক পত্র-পত্রিকায়। সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে তাঁর কবিতাচর্চা। চলতি বছরে বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৮ বয়সে প্রয়াত হন কিংবদন্তি বাঙালি ব্যক্তিত্ব।
৫/১১
তরুণ মজুমদার (৪ জুলাই)— ছিলেন রসায়নের ছাত্র। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পরই পথ পরিবর্তন করেন তরুণ। পা রাখেন চলচ্চিত্র জগতে। ‘চাওয়া পাওয়া’ সিনেমার মধ্যে দিয়েই অভিষেক হয়েছিল চলচ্চিত্র পরিচালনায়। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল— এই কিংবদন্তি-ত্রয়ীর বাইরে বাংলা চলচ্চিত্রের ভিন্ন এক ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন তরুণ মজুমদার। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের উপহার দিয়েছিলেন ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘গণদেবতা’, ‘বালিকা বধূর’ মতো ছবি।
৬/১১
নির্মলা মিশ্র (৩১ জুলাই)— বাংলা গানের স্বর্ণযুগ তখন। সঙ্গীতের দুনিয়ায় রাজত্ব হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যার। সেই সময়ে দাঁড়িয়েই বাঙালি শ্রোতাদের আলাদা স্বাদ এনে দিয়েছিলেন তিনি। পরিচয় করিয়েছিলেন ভিন্ন এক ঘরানার সঙ্গে। ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, ‘তোমার আকাশ দুটি চোখে’ কিংবা ‘ও তোতা পাখি রে’— বাংলাকে তিনি উপহার দিয়েছেন একের পর এক সুপারহিট গান। ওড়িয়া চলচ্চিত্রের জগতেও ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত মুখ। বার্ধক্যজনিত অসুখে দীর্ঘদিন ভোগার পর হৃদরোগে মৃত্যু হয় কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পীর।
৭/১১
দিলীপকুমার রায় (২৩ সেপ্টেম্বর)— নামটা পড়ে অনেকেই হয়তো ঘাবড়ে যাবেন খানিক। না, ইনি দ্বিজেন্দ্রপুত্র নন। তবে বাংলা সঙ্গীতের দুনিয়ায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সম্পর্কে তিনি কান্তকবি অর্থাৎ রজনীকান্ত সেনের দৌহিত্র। দিলীপবাবুর কাছে গামের পাঠ নিয়েছেন হেমন্ত, সন্ধ্যা, পান্নালাল কিংবা অর্ঘ্য সেনের মতো কিংবদন্তি তারকারা। তাছাড়া অতুলপ্রসাদী ও কান্তগীতিকে নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনিই। তৈরি করেছিলেন কান্তগীতির স্বরলিপি। গত সেপ্টেম্বরে বার্ধক্যজনিত অসুখে প্রয়াত হন শতায়ু ‘মাস্টারমশাই’।
৮/১১
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (২ অক্টোবর)— বস্তুবাদ সম্পর্কে ভারতীয়দের যা ধারণা— প্রতিটি আঙ্গিকেই তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তিনি। নব্বই-এর দশক। চার্বাক ও মার্ক্সীয় দর্শন নিয়ে কাজ শুরু করেন দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। সে-সময় প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর শতাধিক গবেষণাপত্র। বলতে গেলে, চার্বাক ও লোকায়ত দর্শনকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে চালিয়ে গেছেন অধ্যাপনাও। বাংলা, ইংরাজি, সংস্কৃত সাহিত্য ও পাঠমূলক সমালোচনা নিয়ে সবমিলিয়ে ২৭টি গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। আক্রান্ত হয়েছিলেন ফুসফুসের ক্যানসারে। এই মারণরোগই প্রাণ নেয় কিংবদন্তি গবেষকের।
৯/১১
ডাঃ দিলীপ মহালানবিশ (১৬ অক্টোবর)— মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। একদিকে পাক-সেনাদের অকথ্য অত্যাচার অন্যদিকে কলেরার প্রকোপ। চূড়ান্ত অভাব স্যালাইনের। এমত পরিস্থিতিতে বাঙালির মুখে সঞ্জীবনী তুলে দেন তিনি। নুন, চিনি ও বেকিং সোডা মিশিয়ে তৈরি করে ফেলেন এক ‘আশ্চর্য’ ওষুধ। এই ওষুধ আর কিছুই নয় আমাদের অতিপরিচিত ‘ওআরএস’। সেসময় এই ‘সাধারণ’ আবিষ্কারই প্রাণ বাঁচায় লক্ষ লক্ষ মানুষের। তবে কোনোদিনই প্রচারের আলোতে আসেননি তিনি। এমনকি মৃত্যকালেও নীরবেই বিদায় নেন কিংবদন্তি বাঙালি চিকিৎসক।
১০/১১
মায়া ঘোষ (৩ ডিসেম্বর)— বাংলা থিয়েটারের নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম শরিক তিনি। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল তাঁর নাট্যজীবন। পরবর্তীতে উৎপল দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘পিএলটি’-রও অন্যতম সদস্যা ছিলেন তিনি। ‘রাজরক্ত’, ‘চাক ভাঙা মধু’ কিংবা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’-এর মতো নাটকে মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন মায়া ঘোষ। তবে শুধু অভিনেত্রীই নন, ছিলেন নাটকের একনিষ্ঠ পূজারী। প্রয়োজনে চেয়ার-টেবিল বয়ে দেওয়া কিংবা মঞ্চসজ্জার কাজেও পিছপা হননি কখনও। এমন এক অভিভাবক-সম ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে ইতি পড়ে বাংলা নাটকের এক বর্ণময় অধ্যায়ে।
১১/১১
যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী (১৯ ডিসেম্বর)— আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার অন্যতম প্রাণপুরুষ যজ্ঞেশ্বর। বিগত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরেই গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাস খুঁড়ে বার করেছিলেন কিংবদন্তি আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ। ক্ষেত্রসমীক্ষা নির্ভর তথ্যসংগ্রহ এবং বিশ্লেষণই ছিল তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। এমনকি গবেষণার জন্য নিয়েছিলেন ভলেন্টিয়ারি রিটায়ারমেন্ট। বর্ধমান তো বটেই, নদিয়া-নবদ্বীপ, টেরাকোটা এবং চৈতন্যদেবের ওপর একাধিক আন্তর্জাতিক মানের কাজ রয়েছে যজ্ঞেশ্বরবাবুর। গত ১৯ ডিসেম্বর হৃদরোগে প্রয়াত হন তিনি।