গত শতাব্দীর তিরিশের দশক। দিকে দিকে একটাই ধ্বনি, স্বাধীন করো দেশ। কেউ শান্তির পথে চলেছেন, কেউ বেছে নিয়েছেন বিপ্লবের পথ। ইংরেজ সাহেবদের মনে ভয় না ঢোকালে ওরা কিছুতেই এই তল্লাট ছাড়বে না। গোটা ভারত তো বটেই, বাংলার বুকেও বিপ্লবের জয়জয়কার। এমন সময়, বাংলার দৈনিকে একটি খবরের দিকে চোখ গেল সবার। ঠিক খবর নয়; ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এক ঘোষণা। যার শিরোনাম ছিল ‘সূর্য সেনকে ধরিয়া দিতে পারিলে দশ হাজার টাকার পুরস্কার।’ বাকি অংশটি এইরকম—
“১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কার্যে বিপ্লবী দলের নেতা বলিয়া কথিত সূর্য সেনকে যে ধরিয়া দিতে পারিবে, বা এমন সংবাদ দিতে পারিবে যাহাতে সে ধরা পড়ে, তাহাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।
আরও পড়ুন
মাস্টারদার পরেই তিনি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ‘সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড’ অম্বিকা চক্রবর্তী
গত ১৩ই জুন তারিখে পটিয়ার বিপ্লবীদের সহিত যে সংঘর্ষের ফলে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হইয়াছেন, সূর্য সেনই নাকি সেই সংঘর্ষের পরিচালক।”
১৯৩২ সালে প্রকাশিত এই বিজ্ঞপ্তিতে সাড়া পড়ে গেল সর্বত্র। শুধু কলকাতা বা অন্যত্র নয়, এর ছোঁয়া এসে লাগল চট্টগ্রামেও। মাত্র দুই বছর আগে এই জায়গাটি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল। দেখেছিল ভারতের বীর বিপ্লবীর দল চাইলে ঠিক কী কী করতে পারে। সেই দলেরই সর্বাধিনায়ক ছিলেন চট্টগ্রামের আদরের ‘মাস্টারদা’। নাম, সূর্য সেন। একজন অঙ্কের মাস্টারমশাই তিনি। ছোটো থেকেই তিনি ছিলেন তেজস্বী। সেই তেজ বারবার বিপদে ফেলেছে ইংরেজদের। তৈরি হয়েছে একের পর এক লোকগাথার। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে একঝাঁক তরুণ-তরুণী। তাঁরাই যে সূর্য সেনের স্বপ্ন!
আরও পড়ুন
প্রেম নিবেদনের কয়েকদিন পরেই ফাঁসি, ১০ বছর ‘ফিরে আসা’র অপেক্ষায় ছিলেন কল্পনা
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর এক এক করে ছিটকে গেছেন সবাই। কেউ ধরা পড়েছেন, কেউ বা গুলিতে বা সায়ানাইডের বিষে মৃত্যুকে গ্রহণ করেছেন। কেউ বা একইরকমভাবে আত্মগোপন করে আছেন। সূর্য সেনকে খোঁজার জন্য তখন সমস্ত জায়গায় ঘুরছে পুলিশ। প্রতিটা বাড়ি, জঙ্গল, পাহাড়— সবকিছু তোলপাড় করে ফেলা হচ্ছে। কোথায় তিনি?
মাস্টারদা তখন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবার। কেউ পুলিশের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা করছে না। করবেই বা কেন? মাস্টারদা’কে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবেন সবাই। তখন ১৯৩৩ সাল। বিপ্লবী দলের কর্মী ব্রজেন সেন সূর্য সেনকে নিয়ে এলেন নিজের গৈরালা গ্রামে। ওই গাঁয়েরই বিশ্বাস বাড়ির বউ ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এতটুকুও ভয় পেলেন না ওই মহিলা। প্রাণ থাকতে মাস্টারদাকে ধরা পড়তে দেবেন না। সেই অনুযায়ী ব্রজেন সেনের সঙ্গে চলত শলাপরামর্শ।
আরও পড়ুন
মৃত্যুর আগের দিন ছুটে গিয়েছিলেন পরিবারের কাছে, বিপ্লবী বাদল গুপ্তকে নিয়ে লিখলেন তাঁর ভাগ্নে
এই পুরো ব্যাপারটাই সন্দেহজনক লাগল নেত্র সেনের। সম্পর্কে ব্রজেনের দাদা-প্রতিবেশী এই মানুষটি ভেবে পেলেন না, কী এমন আলোচনা চলে ছোটো ভাই আর স্ত্রীয়ের মধ্যে! মাঝে মাঝে খাবার নিয়েও কোথায় একটা যায়। কার জন্য এমন আয়োজন? তক্কে তক্কে ছিলেন নেত্র সেন। একদিন স্ত্রীয়ের মুখ থেকেই বেরিয়ে এল সেই ‘গোপন’ কথা। স্বয়ং মাস্টারদা রয়েছেন যে তাঁর আশ্রয়! তাঁকেই সমস্তভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। চোখ চকচক করে উঠল নেত্র সেনের। আনন্দে তো বটেই; তবে এই আনন্দ লোভের। মদ আর জুয়া সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছে। দশ হাজার টাকায় বাকিটা চলবে ভালোই! ‘সোনার হাঁস’ ঘরে এসে ধরা দিয়েছে। এভাবে ফেলে রাখলে চলে নাকি?
বাজারের থলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নেত্র। এদিকে স্ত্রীরও সরল বিশ্বাস, স্বামী আর যাই করুক, মাস্টারদা’র প্রতি তাঁর সম্মান অনেক। যাবতীয় ‘কাজ’ করে ঘরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন নেত্র। অবশেষে রাত এল। ক্রমশ তাঁর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে ক্যাপ্টেন ওয়ামসলী’র নেতৃত্বে এক বিশাল গোর্খা বাহিনী। গোটা তল্লাট ঘিরে ফেলেছে তাঁরা। কথামতো নেত্র সেন সিগন্যাল দিচ্ছে। আচমকা সেই দৃশ্য নজরে এল ব্রজেনের। দাদা এ কী করছেন? মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল সবটা। রাগ ফেটে পড়ছে চোখ মুখ দিয়ে। বিশ্বাসঘাতক! কিন্তু এখন আগে মাস্টারদাকে বাঁচাতে হবে। তৈরি থাকতে হবে বন্দুক নিয়ে। শুরু হল গুলিবর্ষণ।
আরও পড়ুন
বেঁচে গিয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগে, পরে সেখানেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হুগলির ডাক্তারের
শেষ চেষ্টার সুযোগও পাওয়া গেল। বাড়ির পাশেই রয়েছে বেড়া। তারপর এঁদো পুকুর, ময়লায় ভর্তি। তা হোক, কিন্তু এই দুটো পেরোলেই রেহাই পাওয়া যাবে। ব্রজেন সেন আর সুশীল দাশগুপ্ত সক্রিয় হয়ে উঠলেন। কল্পনা দত্ত-সহ আরও কয়েকজনকে ওপারে নিয়ে গেলেন। মাস্টারদাকে নিয়ে যাওয়ার সময়ই গুলি এসে হাতে লাগে। পড়ে যান সুশীল। মাস্টারদা তা সত্ত্বেও চেষ্টা করে যান। যদি পালানো যায়! ওপারেও পৌঁছে গেলেন; কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, নিয়তি! এক গোর্খা সেনার গায়ে গিয়ে পড়লেন সূর্য সেন। দীর্ঘ কয়েক বছরের অপেক্ষার পর, ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন তিনি।
তারপর, পরের নৃশংসতার কথা ইতিহাসে রয়েছে নানা ভাবে। জেলের ভেতর, ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে ফাঁসি হওয়ার আগে পর্যন্ত অকথ্য শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়। সূর্য সেনের সমস্ত নখ উপড়ে ফেলা হয়। দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। প্রায় অর্ধমৃত একটি দেহকে ফাঁসিমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আগের মতোই দৃপ্ত, উজ্জ্বল। তাঁর নামেই যে স্বয়ং সূর্য বিরাজ করছেন! সেই তেজ সহ্য করতে পারল না ইংরেজ। ফাঁসির পর তাঁর মৃতদেহও পরিবারের কাছে দেওয়া হল না। সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হল…
আরও পড়ুন
ফাঁসির দড়িতে বন্ধুত্ব আরও ঘন হয়েছিল বিপ্লবী ‘শায়র’ রামপ্রসাদ আর আসফাকউল্লাহ-র
ঘটনা এখনও শেষ হয়নি। সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার পর সবাই দুঃখে থাকলেও, একজন ছিলেন মহানন্দে। তিনি, নেত্র সেন। আজ বাদে কাল দশ হাজার টাকার মালিক হবেন তিনি। একদিন রাতে খেতে বসেছেন। তখনও মাস্টারদার ফাঁসি হয়নি। এমন সময়, বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। কে এল আবার এত রাতে? টাকার আনন্দে উৎফুল্ল নেত্র সেনের হঠাৎই যেন সমস্তটা অন্ধকার হয়ে গেল। ভোজালির এক কোপে মাথাটা ধড় থেকে আলাদা হয়ে পড়ে গেল। পুরস্কার পাওয়ার আশা শেষ। স্ত্রী বসে আছেন পাশে। ওই দৃশ্য দেখে কাঁপছেন তিনি। আর যে তরুণরা এসেছিল, যাওয়ার আগে তাঁকে আশ্বস্ত করে গেল। আর বলে গেল, ‘বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু!’ তারপর ব্রিটিশ পুলিশ বহুবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তাঁকে। একবারও ওই ছেলেদের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। তিনি নিজেও তো শাস্তি চেয়েছিলেন। তাঁদের প্রাণের মাস্টারদা’কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে যে, তাঁর এমনই শাস্তি হওয়া উচিত!
Powered by Froala Editor