“আমার সন্তান জীবনে কখনও এমন কিছু করেনি যার জন্য আমাদের সামাজিকভাবে লজ্জিত হতে হয়েছে। জীবনটাকে সে নিজের মতো করে কাটাচ্ছে। বাকি সবকিছুর সঙ্গে তার যৌন পরিচয়, সম্পর্ক ও কাজ নিয়েও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। বরং ওর জন্য গর্বিত আমরা। ওর মতো আরও যারা আছে, সবার জীবন ভালো হোক এটাই চাইছি।”
আদালতের মামলার এফিডেভিটে এমন কথাই বলেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী রায়চৌধুরী। ‘তোমার জন্য বাবা-মা হিসেবে আমরা গর্বিত’— এই কথাটি প্রথমে ছিল না। বিজয়লক্ষ্মীদেবীর কথাতেই আলাদাভাবে এই কথাটি যুক্ত করা হয়। নিজের সন্তান অনীশ রায়চৌধুরী শুধু নয়, তাঁর মতো আরও অনেকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর মতো আরও বহু মায়েরা। হাতে হাত মিলে তৈরি হয়েছিল বন্ধন; যা শক্তি জুগিয়েছিল বহু মানুষকে। উপলক্ষ? ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অবলুপ্তিকরণ বিষয়ক মামলা…
অবলুপ্তি? শব্দটি কি ঠিকঠাক ব্যবহৃত হল? আইনের দিক দিয়ে দেখতে গেলে— না! ৩৭৭ ধারার অবলুপ্তি নয়, বরং বলা ভালো তার ভেতরের কিছু বক্তব্যের সংশোধন। ১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে যুক্ত হওয়া এই ধারা অনুযায়ী, সমলিঙ্গের দুজন মানুষের (পুরুষ এবং নারী) সম্পর্ককে দেখা হত বেআইনি হিসেবে। বলা বাহুল্য, সমগ্র আইনের একটি অংশ নিয়েই মতভেদ উঠেছিল। উভয়পক্ষের সম্মতি থাকলেও অনেকসময় তা গ্রাহ্য করা হত না। এই ব্যাপারটাকেই সমূলে বাইরে আনা হয়েছে ২০১৮ সালে। তার আগে ২০০৯ সালেও দিল্লি হাইকোর্ট ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়েছিল ৩৭৭ ধারার এই অংশকে। এবং তার পেছনেই রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ছয়জন যুবকের অভিভাবকেরা, যাঁদের পিটিশন এই আইনি লড়াইয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্ট যখন ২০১৩ সালে ৩৭৭ ধারার ‘অসাংবিধানিক’ তকমা খারিজ করেন, তখন বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে পিটিশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাতে এই ধরণের নিয়মের অবলুপ্তি হয়। সেগুলোরই একটি অংশ ছিল ‘পেরেন্ট ফোরাম’। ভারতের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের ১৯ জন মানুষের অভিভাবকেরা এর অংশ হন। তাঁদের মধ্যে বাংলা থেকে ছয়জন ছিলেন। অনীশ রায়চৌধুরীর মা-বাবা দুজনেই যুক্ত ছিলেন। সমাজের সমস্ত বাধা পেরিয়ে তাঁরা সামনে এসেছিলেন তাঁদের সন্তানদের জন্য, আরও অনেক ‘অনীশ’দের জন্য। ‘আমরা আমাদের সন্তানের জন্য গর্বিত’— বুক চিতিয়ে এই কথাটাই বারবার বলে যাচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন
মধ্য আমেরিকার প্রথম সমলিঙ্গ বিবাহ কোস্টারিকায়, সাক্ষী রইল গোটা দেশ
জয়দীপ জানার কাছেও লড়াইটা সহজ হয়ে যায় যখন দেখেন তাঁর মা, মমতা জানা সঙ্গে রয়েছেন। সন্তানের জীবনযুদ্ধ দেখে তিনি পাশে এসে দাঁড়ান। মমতাদেবীর মনে হয়েছিল ‘ওই মুহূর্তে সন্তানের পাশে দাঁড়ানোটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি পাশে না থাকি তাহলে তো কেউ থাকবে না। আর বাকিদের থাকা বা না থাকার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের পাশে থাকা।’ সেটাই করেছিলেন মমতা জানা। কথা কি শুনতে হয়নি? ৩৭৭ ধারার সংশোধনের দু’বছর পরও যখন সমকামী মানুষদের উদ্দেশ্যে ছুটে আসে নিন্দা, কটূক্তি, কখনও কখনও শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহও চরম পর্যায়ে চলে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী হোক বা পরিবার, সমাজের বাকি অংশ— তাঁদের কাছ থেকেও অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে।
কিন্তু হার মানেনি তাঁরা। অনীশ রায়চৌধুরী, জয়দীপ জানা’র সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছিলেন তীর্থঙ্কর গুহঠাকুরতা এবং রাজর্ষি চক্রবর্তীও। ছিলেন তাঁদের পরিবারও। সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের আরও হাজার হাজার সমকামী মানুষ। অনেকের ভাগ্য এঁদের মতো নয়; প্রতি পদে সমাজের ধাক্কা খেতে হয়। নিগ্রহ সহ্য করতে হয় পরিবারের। তাঁরাও তো মুখ চেয়ে আছে! “২০১৮-এর সেপ্টেম্বরের পর ৩৭৭ ধারা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পেরেছে মানুষজন। খুব সত্যি কথা বলতে, এই নিয়ে বেশি আলোচনাও তো হয়নি তার আগে। আগের থেকে সংখ্যায় বাড়লেও, এখনও মুক্তমনে আলোচনা খুব কমই হয়”, বলছিলেন জয়দীপ। প্রায় একই সুর শোনা গেল অনীশের গলাতেও। “এই ব্যাপারে যখনই কথা বলি তখনই আমি ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করি। কারণ একা আমি এই লড়াইয়ে সামিল হইনি। আমি ভাগ্যবান যে আমার বাবা এবং মা দুজনেই এই লড়াইয়ে আমার সঙ্গে ছিলেন। পরিবারের বাকি মানুষদের কাছ থেকে অনেক বাধা পেলেও কখনও হার মানেননি। সেটাই আমাকে জোর দিয়েছে। কিন্তু সবার ভাগ্য তো এরকম নয়! তাঁদের জন্যই এই লড়াই। সমাজের চিরাচরিত গোঁড়া মানদণ্ডের বিরুদ্ধেই তো দাঁড়াচ্ছি আমরা।”…
২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারই জয় দেখেছিল ভারত। তবে এখনও থামেনি লড়াই। আইনি লড়াই বাদ দিয়ে সামাজিক লড়াইও গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজটাই করতে হবে এখন। এখনও এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের অত্যাচারিত হতে হয়। আইনের রক্ষকই অনেক সময় ভক্ষক হয়ে যায়। কিছু কি করতে পারি আমরা? এখানেই বদল আনতে হবে। এখান থেকেই লড়াইটা আরও দূর এগিয়ে যাবে। দু’বছর পেরোনোর পর এটাই আসল মন্ত্র…
Powered by Froala Editor