এই মুহূর্তে গোটা ভারতবাসীর নজরে একটাই দেশ— চিন। করোনা ভাইরাসের এমন অতিমারীর সময়ও দুই দেশের মধ্যে চলছে চাপানউতোর। কী হবে পরিস্থিতি, কোনদিকে গড়াবে কেউ জানেন না। ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’ কথাটি হঠাৎ যেন ফিকে হয়ে গেছে। ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকালেও কি এমন দৃশ্যই দেখতে পাব? তা নয়। ভারত তো বটেই, এই বাংলার সঙ্গেও চিনের একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল। একটা সময় দুটো দেশই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই চলেছে যোগাযোগ। আর সেই যাত্রায় অংশ নিয়েছে বাংলাও।
বাঙালি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সঙ্গেও যুক্ত আছে চিন। ১৯২৪ সালে তাঁর সেই ৪৯ দিনের ঐতিহাসিক ভ্রমণের কথা মনে করতেই পারেন। তাঁর ‘একলা চলো রে’-র বাণীই সেদিন গ্রহণ করেছিল চিন। আর ছিল শান্তি। সেখানেই থেমে থাকেনি সম্পর্ক। এরপর চিন থেকেও বাংলায় এসেছেন অনেকে; গিয়েছেন কবিগুরুর প্রিয় শান্তিনিকেতনে। ১৯৩৭ সাল থেকে সেখানে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ‘চিনা ভবন’; যা দুই দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হেরিটেজ স্থান। যে জায়গাটি মনে করায় রবীন্দ্রনাথ এবং তান ইয়ুন-সান’কে। চিনা সংস্কৃতির অধ্যায়নের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো স্থান এটি। ইতিহাস এসবই নিয়ে আসে আমাদের সামনে। কিন্তু আড়ালে থেকে যায় অনেক কিছু। যেমন আমরা অনেকেই জানি না, চিনের রেডিও থেকে এখনও সম্প্রচারিত হয় বাংলা ভাষা! এমনকি, চিনে আছে আস্ত একটা বাংলা ভাষার খবরের ওয়েবসাইট!
সময়টা গত শতাব্দীর বিশের দশক। রেডিও জিনিসটা পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। সেই ঢেউ এসে পড়ল চিনেও। আস্তে আস্তে ঘরে ঘরে ঢুকতে শুরু করল বেতার যন্ত্র। ১৯৪১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রথমবার এয়ার হল রেডিও পিকিং। তখন চিন তো বটেই, গোটা বিশ্বে যুদ্ধের দামামা বাজছে। সময় যত এগিয়েছে, ততই রেডিও পিকিংয়ের গুরুত্বও বেড়েছে। পরে এই রেডিও স্টেশনেরই নাম বদলে যায়। আজ যাকে ‘রেডিও ইন্টারন্যাশনাল চায়না’ (সিআরআই) বলে চেনে গোটা বিশ্ব। আজও একই জনপ্রিয়তায় কাজ করে যাচ্ছে এই স্টেশন। আর এই কাজের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাংলাও। গোটা বিশ্বে মোট ৬৫টি ভাষায় রেডিও সম্প্রচার হয় এখান থেকে, তাদের মধ্যেই অন্যতম হল বাংলা ভাষা। সেখানে বাংলায় খবর তো পড়া হয়ই; সঙ্গে বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতও। আর সেই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত আছেন সেখানকার মানুষরা।
১৯৬৯ সালের প্রথম দিনটি থেকেই বাংলা ভাষা ঢুকে পড়ে চিনের ইন্টারন্যাশনাল রেডিওতে। একদম প্রথম ডিরেক্টর ছিলেন লি এল জুন, যিনি হিন্দি শাখারও দায়িত্বে ছিলেন। আস্তে আস্তে সময় এগিয়েছে। ডিরেক্টর ও কর্মী দুইই বেড়েছে। এখন বাংলা বিভাগের প্রধান চাংসিং; তাঁরই অধীনে রয়েছেন প্রায় ৩০ জন। সবাই যে চিনা তা নয়, বাঙালিরাও আছেন। কিন্তু ভাষা একটাই— বাংলা! আর আশ্রয়? রবীন্দ্রনাথ! এমনকি রবি ঠাকুরের লেখার অনুবাদের কাজও জোরকদমে চলছে এখানে।
আরও পড়ুন
২৪২ বছর আগে বাংলায় চিনা উপনিবেশ, অধরাই রইল ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ তৈরির পরিকল্পনা
তবে শুধু বেতার প্রচারই নয়; রেডিও ইন্টারন্যাশনাল চিনের বাংলা বিভাগের জন্য রয়েছে একটি আস্ত ওয়েবসাইট। যেখানে ওপর থেকে নিচ, পুরোটাই বাংলা। এভাবেই আজও তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বাংলা। আর সুতোটুকু বেঁধে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালিরা তো বটেই, চিনা ছেলেমেয়েরাও যখন নিজেদের গলায় গেয়ে উঠছেন ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে’, তখন কোথাও বন্ধনটা ঘুচে যায়। তৈরি হয় একটা অদৃশ্য সেতুর। বাংলা ভাষার হাত ধরেই সেখানে হাজির হই আমরা।
আরও পড়ুন
অভিযাত্রী গালওয়ানের নামেই নামকরণ উপত্যকার, নিজেও সাক্ষী ছিলেন চিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ভারত-চিন যুদ্ধ, সেন্সর বোর্ডের কোপে মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’