সোফোক্লিস রচিত কিংবদন্তি ট্রাজেডি হল ‘অয়দিপাউস’। সকলেই জানেন, রাজা অয়দিপাউস না জেনে তার মায়ের সঙ্গে সহবাস করেছিল এবং বাবাকে খুন করেছিল। এই পাপে মড়ক লেগেছিল থিবস নগরে। এই ‘সত্য’ অয়দিপাউস যখন জানতে পারে, সে নিস্ফল ক্ষোভে নিজের দুটি চোখ অন্ধ করে দেয়।
ইতালীয় চলচ্চিত্রকার পিয়ের পাসোলিনি, সোফোক্লিসকে অবলম্বন ক’রেই তুলেছিলেন ‘অয়দিপাউস রেক্স’ (১৯৬৭)। সমকাল ও ইতিহাসের দুঃস্বপ্ন একাকার হয়ে যায় ছবিতে। পরিচালক হয়তো বলতে চান, আজকের সভ্যতাও এই পাপে ভুগছে – তার প্রায়শ্চিত্ত এখনও ফুরোয়নি। থিবসের রাস্তায় এখনও হেঁটে যাচ্ছে অন্ধ রাজা!
মনে পড়ছে লুইস বুনুয়েল-এর ‘নাজারিন’ (১৯৫৯) ছবির কথা। সমকালীন ইউরোপে এক বেশ্যা ও এক বামনের সঙ্গে নগ্ন পায়ে হাঁটছে উদভ্রান্ত নাজারিও। সে কি রোগ সারিয়ে দিতে পারে, যেমনটা বিশ্বাস করছে জনতা? সে কি সত্যিই এক প্রফেট, যে আবার উত্থিত হয়েছে? নাজারিও-র মধ্যে বুনুয়েল এনেছেন ঈশ্বরপুত্র যিশু-র স্পষ্ট ছায়া। আধুনিক যুগের যন্ত্রণা পুরাণের ছায়া পেয়ে তীব্র আর শিল্পিত হয়ে ওঠে।
যৌথ অবচেতনা ও মিথ নিয়ে অতীতে কাজ করেছেন ফ্রয়েডের শিষ্য কার্ল ইয়ুং। লেভি-স্ট্রাউস ও রলাঁ বার্তের মতো তাত্ত্বিকেরা মিথোলজি নিয়ে লিখেছেন প্রচুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সিনেমাতেও এর অভিঘাত ছিল ব্যাপক।
লুইস বুনুয়েল ও পিয়ের পাসোলিনি, উক্ত দুজনকেই সাংঘাতিক পছন্দ করতেন ঋত্বিক ঘটক। ‘মেঘে ঢাকা তারা-র সময় থেকেই আমি মিথিকাল ওভারটোন প্রয়োগ করা শুরু করি’, সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন তিনি।
‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬১) ছবিতে এই প্রয়োগ সর্বাধিক সফল ও বিধ্বংসী। রামায়ণের প্রাচীন গল্পই ফিরে বলা হয়েছে এখানে। ...দাদা কেন বেশ্যালয়ে যেতে গিয়ে তার বোনের ঘরেই ঢুকল? এ কি অতিরিক্ত সমাপতন নয়? শোনা যায়, পরিচালক জবাব দিয়েছিলেন, ‘সে যে ঘরেই যেত, সেটা তার বোনের ঘরই হত।’
এ ছিল আমাদের জাতীয় পাপ, অজাচারের পাপ। যেন পৌরাণিক যুগ থেকেই আমাদের দেশ এই পাপে ন্যুব্জ, সমকালের আগুন ও রক্তপাত বিচ্ছিন্ন কিছু নয়!
এবং শুধুই ঋত্বিক নন। পরবর্তী সময়েও এই অভ্যাস মনে রেখেছেন এই দেশের একাধিক পরিচালক। ‘পরশুরাম’ (১৯৭৯) ছবির নামেই মৃণাল সেন রেখেছিলেন পুরাণের দ্যোতনা, ছবিতেও সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। তাঁর হিন্দি ছবি ‘জেনেসিস’ (১৯৮৬)-এও রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্টের অভিশপ্ত আখ্যানের ছায়া।
আসলে কী বলতে চান এই শিল্পীরা? আজকের সংবাদপত্রে যে হিংসা ছড়িয়ে থাকে, তার থেকে খুব দূরে নয় আদিম চরিত্রগুলি? আধুনিক মানুষের কায়াতেই হয়তো অয়দিপাউস, রাবণ, সীতা কিংবা খ্রিস্টের ছায়া উঁকি দিয়ে যায়!
বাণিজ্যিক সিনেমা ও টেলিভিশনে বারে বারেই এসেছে এ-দেশের দু’টি মহাকাব্যই। আশির দশকের অন্তে রামানন্দ সাগর কিংবা বি আর চোপড়া পরিচালিত অতিখ্যাত ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ সিরিয়াল সকলেরই মনে আছে। বলতেই হবে ১৯৬৫ সালে নির্মিত মূলধারার হিন্দি ছবি ‘মহাভারত’-এর কথা। জনতার চিত্তজয়ে এগুলি যথেষ্ট সফল এবং এই ধারা এখনও চলেছে।
শ্যাম বেনেগাল-এর ‘কলযুগ’ (১৯৮১) ছবিতে দেখা গেছে অন্য রকম প্রয়াস। মহাভারতের ভ্রাতৃঘাতী হিংসা এই ছবিতেও স্পষ্ট, তবে তা এসেছে একটি আধুনিক গল্পের ছদ্মবেশে। ভারতের প্যারালাল ছবিতে এরকম উদাহরণ কম নয়, যেখানে উশকে দেওয়া হয়েছে পৌরাণিক স্মৃতি ও বিপন্ন জিজ্ঞাসা।
টেলিভিশন বা বাণিজ্যিক ছবিতে মহাকাব্যের দরকার পড়ে কেন? তার উদ্দেশ্য অতি সরল – জনচিত্তের স্বস্তিকর বিনোদন। এরই সম্পূর্ণ উলটো উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাচীন আখ্যানের কাছে ফিরে যান আভাঁ-গার্দ সিনেমাকার। তাঁর সিদ্ধান্ত ও পদ্ধতি দুটিই হয় অতি কড়া-অর্থে ‘রাজনৈতিক’।
ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র জন আব্রাহামের তুলনাতীত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি ‘অগ্রহারাথিল কারুথাই’ (১৯৭৭) এই গোত্রে পড়বে। কুলীন গ্রামে একটি পশুহত্যার ‘লোককথা’ বলেছে এই মালয়লম ছবি। পুরাণের চোরা-ফাটলকে কাজে লাগিয়েছেন পরিচালক, তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে সভ্যতার ইতিহাস।
‘শেষ পঞ্চাশ’-এর জন্য আমরা যে ছবির কথা বিশেষ ক’রে বলব, তার নাম ‘যদু বংশ’ (১৯৭৪)। কাহিনিকার বিমল কর। পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী। করুণ ছবি ‘ছায়া সূর্য’ (১৯৬৩) তাঁর প্রথম প্রয়াস ছিল, সত্তর দশকে এসে তিনি সহ্যের-অতীত তিক্ত হয়ে গেছিলেন।
ছবিটা দেখতে বসে আমাদের মনে পড়ে গিয়েছে একটি প্রাচীন ও নৃশংস আখ্যান।
‘মুষলপর্ব’-এর গল্প আমাদের জানা। তুচ্ছ কারণে এক আত্মঘাতী যুদ্ধে সমগ্র যদু বংশ নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। সেই স্মৃতি যেন অশুভ ছায়া ফেলেছে সত্তর দশকের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে।
ছবির টাইটল সিকোয়েন্সটি কারো মনে আছে? ...যেখানে মাস্তান যুবকরা ছুটে যাচ্ছে সাইকেল ক’রে, তাদের পিছু নিচ্ছে পুলিশের ভ্যান? মুহুর্মুহু ফ্রিজ হচ্ছে তাদের উল্লাস, দেঁতো হাসির ক্লোজ আপ। ইন্টারকাট ক’রে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না, ভিয়েতনাম যুদ্ধ!
এবং, ইমেজের তলা দিয়ে ফিল্ম রিলের মতো সরে যাচ্ছে টাইটল, নেপথ্যে শিস দিচ্ছে কেউ বা কারা, বিসর্জনের সাউন্ড-স্কেপ যেন!
রক্তমাখা দশককে কুরে কুরে কেটেছে পোকা, আমাদের দেশ একটা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছু নয়।
এই উগ্র যুবকেরাই পাপ ডেকে আনবে শহরে। একটি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝি, তা থেকে কুৎসিত বচসা এবং মারামারি। অপমানে আত্মহত্যা করেন প্রহৃত গণাদা। ...উত্তমকুমার, ধৃতিমান সহ কলাকুশলীদের মধ্যেই বলরাম, সাত্যকি, কৃতবর্মাদের আমরা চিনতে পেরে যাই।
কথিত আছে, ‘মুষলপর্ব’-এর শেষে যাদবদের মধ্যে একজন পুরুষও জীবিত ছিলেন না। দ্বারকা জুড়ে নেমে এসেছিল শ্মশানের শান্তি। ...‘যদু বংশ’ ছবির অন্তে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাদা-কালো রঙে দীর্ণ, বিষণ্ণ ইমেজ। মৃত্যুর জন্য ‘দায়ী’ যুবকেরা কৃতকর্মের কথা ভেবে অনুতপ্ত। গণাদা (উত্তমকুমার)কে দাহ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে শ্মশানে, তারাও এগিয়ে যাচ্ছে সেই দিকেই।
১৯৭৪ সালের এই বাংলা ছবিতে জাতীয় কাব্য ‘মহাভারত’-কে এডাপ্ট করা হয়নি, অবিনির্মাণ করা হয়েছে। এই দেশে সিনেমার কোনো ইতিহাস থাকলে আমাদের কথা অবশ্যই তার সমর্থন পাবে।
Powered by Froala Editor