“প্রথম দশকে আমি যখন আসাম থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় এলাম, দেখলাম ১৯ মে-র ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারটা এখানে অনেকেই জানেন না। অথচ, ৬০-এর দশকে এই ঘটনার সময় ধারাবাহিকভাবে লেখালিখি হয়েছিল আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, বসুমতী, যুগান্তর ইত্যাদি পত্রিকায়। কলম ধরেছিলেন বনফুল, দক্ষিণারঞ্জন বসু, মনিষ ঘটক প্রমুখরাও…”
বলছিলেন শান্তনু গঙ্গারিডি (Shantanu Gangaridi)। ২০০৮ সাল থেকে তাঁর সম্পাদনাতেই কলকাতার বুক থেকে প্রকাশিত হয়েছে আসছে ‘উনিশে মে’ (Unishe May) পত্রিকা (Magazine)।
বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯ মে তারিখটির গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৬১ সাল সেটা। সেবার বাংলা থেকে বহু দূরে আসামের শিলচরে আলোড়ন তুলেছিল সংগঠিন আন্দোলন। লক্ষ্য ছিল, আসামেও বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়। পথে নেমেছিলেন অসংখ্য ভাষা সত্যাগ্রহী। ১৯ মে শিলচর রেলস্টেশনে এই প্রতিবাদ অবস্থানের ওপরই নির্মমভাবে গুলি চালায় আসাম পুলিশ। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ১১ ভাষা আন্দোলনকারীর।
আরও পড়ুন
বাংলার চাপে কোণঠাসা, ৭টি বিপন্ন ভাষার শব্দকোষ বাংলাদেশে
হ্যাঁ, এই ঐতিহাসিক দিনটির গুরুত্ব এবং বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন শান্তনু গঙ্গারিডি। পত্রিকার নামকরণও এই তারিখ অনুকরণেই। শান্তনুবাবু জানালেন, “মানুষের মননে, চেতনায় আঘাত দেওয়ার জন্যই ‘উনিশে মে’ নামটি বেছে নিই।”
আরও পড়ুন
পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি আজও, কোন ভাষায় লেখা ‘রোহঙ্ক কোডেক্স’?
২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন যেমন বাঙালি জাতিসত্তার উত্থানের প্রতীক, তেমনই ১৯ মে-র ভাষা আন্দোলন ছিল আজকের বহুভাষী রাজ্যের পরিকাঠামো নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো রাজ্যের ৭০ শতাংশ মানুষ যদি কোনো নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে একমাত্র তখনই একটা ভাষা ওই রাজ্যের সাংবিধানিক ভাষা হতে পারে। কিন্তু ষাটের দশকে অসমিয়া আসামের একমাত্র সাংবিধানিক ভাষা হলেও, আসামের ৪০ শতাংশের বেশি নাগরিক ছিলেন অন্য ভাষাভাষীর। সেখান থেকেই সূত্রপাত আন্দোলনের। অসমিয়ার পাশাপাশি বাংলাও রাজ্যেরও দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা পাক সেটাই দাবি ছিল আন্দোলনের।
আরও পড়ুন
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পেল তেলেগু, বড়োদিনের বড়ো উপহার
তবে শুধুই কি বাঙালিরা অংশ নিয়েছিলেন এই আন্দোলনে? “আসামের বহুভাষী চরিত্র রক্ষার জন্য গারো, খাসি, মিজোরাও কিন্তু মিছিল করেছিল। এমনকি আসামের বিধানসভায় যিনি প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন, তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপ্রিয়। মনে রাখতে হবে, তিনি বাঙালি বিধায়ক নন”, জানালেন শান্তনুবাবু।
এই আন্দোলনের অভিঘাতেই পরবর্তীতে জন্ম নেয় ‘শাস্ত্রী সূত্র’, ‘ত্রিভাষা চুক্তি’। সংখ্যালঘু ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রাপ্তিও এই আন্দোলনেরই ফলাফল। কিন্তু খাতায়-কলমে আইন থাকলেও, বাংলা ছাড়া ভারতের কটি রাজ্যে রক্ষিত হচ্ছে এই বহুভাষী চরিত্র? ত্রিভাষা চুক্তিও কি আদৌ মেনে চলছে ঝাড়খণ্ড বিহারের মতো রাজ্যগুলি? প্রশ্ন তুললেন ‘উনিশে মে’-র সম্পাদক। জানালেন, “ভাষা আগ্রাসনের সূত্রপাত কিন্তু এই জায়গা থেকেই। পশ্চিমবাংলায় অন্যান্য ভাষাদের প্রাধান্য দেওয়া হলেও, অন্যান্য রাজ্যে কি বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়? তাছাড়া ইতিমধ্যেই ৫৩টি স্বতন্ত্র ভাষাকে হিন্দির উপভাষা হিসাবে বর্ণনা করেছে সরকার। রাজস্থান, গুজরাট কিংবা দক্ষিণের রাজ্যগুলিতেও একইভাবে ভাষা আগ্রাসনের শিকার সংখ্যালঘু ভাষারা।”
এই প্রেক্ষাপটে মানুষের মধ্যে নতুন করে সচেতনতা গড়ে তুলতে ১৯ মে-র ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। আর সেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাসকেই বাঙালি পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছে ‘উনিশে মে’ পত্রিকা, শান্তনুবাবুর উদ্যোগে। টানা দেড় দশক ধরে প্রকাশিত হওয়া এই পত্রিকা যেন পরিণত হয়েছে চলমান একটি ভাষা আন্দোলনে। শান্তনুবাবু জানালেন, “মহামারী এবং লকডাউনের পরিস্থিতিতেও বন্ধ হয়নি পত্রিকার কাজ। নিয়ম মেনেই ১৯ মে প্রকাশ পেয়েছে এই পত্রিকা।” ছাপার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ পেয়েছে ডিজিটাল সংখ্যাও। চলতি বছরেও অন্যথা হচ্ছে না তার। আজ প্রকাশ পাবে ‘উনিশে মে’-র নতুন সংখ্যা। সেইসঙ্গে পত্রিকার ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশ পাচ্ছে আরও একটি সংকলন গ্রন্থ ‘উনিশের পদাবলি’। থাকছে, বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত ৩১৮ জন কবির কবিতা। শান্তনুবাবুর বিশ্বাস, একমাত্র জনসচেতনতাই ইতি টানতে পারে ভাষা রাজনীতিতে। প্রশাসনিক স্তরে সংখ্যালঘু ভাষার ব্যবহার রেশ টানতে পারে আগ্রাসনের। অক্লান্তভাবে সেই লড়াইয়ের ভার বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি…
Powered by Froala Editor