কলকাতা তখন আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ঐশ্বর্যশালী শহর নয়। বরং দীর্ঘ শোষণের পর তার চেহারা অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এমনকি রাজধানীও সরে গিয়েছে দিল্লিতে। তবু আপামর বাঙালির কাছে কলকাতা সত্যিই তিলোত্তমা। আর সেই তিলোত্তমার অনুকরণেই নিজের একটি শহর গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন এক বাঙালি জমিদার। না, শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। কিন্তু আজও বাংলাদেশে যমুনার ধারে খুঁজে পাওয়া যায় সেইসব ব্যর্থ চেষ্টার অনেক নিদর্শন।
যতদূর জানা যায়, উনবিংশ শতকে সুবিন্ধা খাঁর সূত্র ধরেই চৌধুরী বংশ টাঙ্গাইলের নাগরপুরে জমিদারি শুরু করে। সেই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যদুনাথ চৌধুরী। বিশ শতকে জমিদারির ভার নেন উপেন্দ্রমোহন চৌধুরীর বড়ো ছেলে সতীশচন্দ্র চৌধুরী। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন রায় বাহাদুর উপাধি। সেই থেকেই বংশের পদবী হল রায়চৌধুরী। বিভিন্ন মানবকল্যাণমূলক কাজের পাশাপাশি সতীশচন্দ্রের ছিল এক শৌখিন মেজাজ। উন্নত শিল্পসামগ্রীর প্রতি যেমন আকর্ষণ ছিল, তেমনই ছিল মজলিশি মানসিকতা। আর তাই জমিদারির কাজের সূত্রে যখন তিনি কলকাতা এলেন, তখন শহরের চেহারা তাঁকে মুগ্ধ করল। আর তার পরেই ঠিক করে ফেললেন, নাগরপুর শহরকে তৈরি করবেন একেবারে কলকাতা শহরের আদলে।
অবশ্য এইখানে একটু ভুল করেছিলেন সতীশচন্দ্র। কলকাতা শহর তো একদিনে তৈরি হয়নি। কোনো একজন মানুষের প্রচেষ্টাতেও তৈরি হয়নি কলকাতা। আর এভাবে হয়তো সম্ভবও নয়। কিন্তু জমিদারের বিলাসী মন আর কবেই বা এসব যুক্তিতর্কের ধার দিয়ে গিয়েছে? তাই ভাই সুরে চন্দ্রকে দায়িত্ব দিলেন নাগরপুরে এক সুরমা প্রাসাদ তৈরি করার। আর সেইসঙ্গে বাকি শহরকেও ঢেলে সাজানোর। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হল সুদৃশ চিড়িয়াখানা। তাতে শোভা পেত ময়ূর, কাকাতুয়া, হরিণ, ময়না। এমনকি পরে একটি বাঘ ও একটি সিংহীকেও রাখা হয়েছিল চিড়িয়াখানায়। পাশাপাশি কলকাতার মতো পূর্ববঙ্গকেও ক্রীড়ামোদি করে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন সতীশচন্দ্র। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যেও তিনি ছিলেন একজন।
তবে সবটাই যে কলকাতার অনুকরণে হয়েছিল তা নয়। নাগরপুর শহরের বুকে তৈরি হয়েছিল আস্ত একটি নহবতখানা। সেখানে প্রতিদিন সকালে সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙত মানুষের। কিন্তু এমন একটা শহর শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে হারাল সমস্তকিছু। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হিন্দুদের সঙ্গে কলকাতায় চলে এলেন সতীশ চন্দ্র। দ্বিতীয় কলকাতায় নয়, তাঁর ঠাঁই হল আসল কলকাতা শহরেই। কিন্তু সেখানে বিলাসিতার লেশমাত্র নেই। অন্যান্য উদ্বাস্তুদের মতোই আর্থিক কষ্টের মধ্যে কেটেছে তাঁর শেষ জীবন। তখনও কি তিনি আরেকটা কলকাতা গড়ে তোলারই স্বপ্ন দেখতেন? নাকি স্বপ্ন দেখতেন এমন এক শহরের যেখানে হিংসা-হানাহানির কোনো ছায়া পড়েনি?
আরও পড়ুন
২৪২ বছর আগে বাংলায় চিনা উপনিবেশ, অধরাই রইল ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ তৈরির পরিকল্পনা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্রথম রেলপথের পরিকল্পনা করেছিলেন দ্বারকানাথ, আমরা কি মনে রেখেছি সেই কথা?