শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ নয়; আফ্রিকার এই দেশটিরও সরকারি ভাষা বাংলা

‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’। এই ভাষার হাত ধরেই কত লড়াই, কত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছি আমরা। শুধুমাত্র নিজের ভাষাকে, সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জন্য মানুষ প্রাণ দিতে পারে, এমন নজির কি ১৯৫২-র আগে দেখেছিল পৃথিবী? বাংলা মানে কেবল ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ নয়; গোটা বিশ্বের কাছে এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। তবে আমাদের চেনা বঙ্গীয় গণ্ডির বাইরেও ছড়িয়ে আছে বাংলা ভাষা। সমুদ্র পেরিয়ে সে হাজির হয়েছে আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে। আর সেখানেই সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা। দূরত্ব অনেক হলেও, আমাদের সঙ্গে একই শব্দে, অক্ষরে উদযাপনে মেতে ওঠে দেশটি…

আফ্রিকা মহাদেশের একদম পশ্চিম উপকূলের দিকে গেলে সন্ধান মিলবে এই ছোট্ট দেশটির। আটলান্টিক মহাসাগরের ধারে হলেও, নিরক্ষীয় শুখা মরসুমের ঝাপটা এসে পড়েছে সিয়েরা লিওনে। খনিজ সম্পদ যেন দেশটির মাটিকে ভরিয়ে রেখেছে। বক্সাইট, টাইটেনিয়াম, সোনা, হিরে— এমন ভাণ্ডার যার, তার দিকে তো গোটা বিশ্বের নজর থাকবে। ঠিক এইভাবেই একটা সময় ব্রিটিশদের নজরে পড়ে এই দেশ। তখন তো গোটা বিশ্বে উপনিবেশ বিস্তার করার লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে তারা। বণিকের মানদণ্ড দেখতে দেখতে রাজদণ্ডে পরিণত হয়। এশিয়ার পাশাপাশি আফ্রিকাতেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে ব্রিটিশরা। সিয়েরা লিওন উপকূলবর্তী দেশ, তার ওপর এমন খনিজ সম্পদ— ছড়ি ঘুরিয়ে সিংহাসনে বসতে বেশি সময় লাগল না।

দীর্ঘদিন দেশটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। অন্যান্য উপনিবেশের থেকে সিয়েরা লিওনের অবস্থা আলাদা ছিল না। ব্রিটিশদের অত্যাচার, দমননীতি চলত অবিরত। একটা সময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। চল্লিশের দশকের পৃথিবীর ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে, ব্রিটিশদের প্রতিপত্তি তখন প্রায় শেষ লগ্নে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝড় ইংরেজদের ওপর দিয়ে গেছে। স্বাধীনতার হাওয়া সমগ্র জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। ১৯৪৭-এ দেশভাগ হয়ে স্বাধীনতা পেল ভারত। সিয়েরা লিওনের মতো আফ্রিকার অনেক দেশই তখন স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে আছে। ১৯৬১ সালে শেষ পর্যন্ত সেই বিশেষ দিনটি এল। ব্রিটিশ শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেল সিয়েরা লিওন। এত বড়ো খনিজ এলাকা, উপকূল সব এখন সিয়েরা লিওনবাসীদের হাতে। এবার হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে…

যা ভাবা হয়, তা কি সবসময় হয়? সিয়েরা লিওনের অদৃষ্টেও একই জিনিস লেখা ছিল। ১৯৬১ সালে স্বাধীনতার পর দেশের প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসেন স্যার মিল্টন মারগাই। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেননি সেখানে। ভেবেছিলেন, দেশটাকে উপযুক্তভাবে গড়বেন তিনি। সবাইকে নিয়ে চলবেন। হল না। তিন বছরের মধ্যে মারা গেলেন মিল্টন। এবার সিংহাসনে কে বসবেন? যে পরিকাঠামো তৈরি করেছিলেন মিল্টন মারগাই, সেসব আস্ত থাকবে কি? প্রশ্নগুলো একটু একটু করে উঠতে আরম্ভ করল; কারণ পরিস্থিতি হঠাৎ করেই যেন বদলে গেল। ভেতরে ভেতরে সিয়েরা লিওন যেন ভেঙে পড়তে শুরু করল। দুর্নীতি, অপরাধ, হিংসা— সব মিলিয়ে এক অস্থির পরিস্থিতির সামনে দাঁড়ায় দেশটি। জনগণ ভেবেছিলেন, তাঁদের এই ক্লিশে অবস্থার পরিবর্তন হবে। সেই আশা ক্রমশ মুছে যেতে লাগল…

আরও পড়ুন
পাঁচতারা হোটেলের জন্য জমিদখল, প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী ‘ম্রো’-রা

দীর্ঘদিন ধরে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে, দেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটা অসন্তোষ তৈরি হয়। আর সমাধানের রাস্তা না খোঁজার চেষ্টা করলে, পরিণতি যে খুব একটা ভালো হয় না সেটাও বলাই বাহুল্য। ঠিক সেটাই হল। যে দেশটির এমন সমৃদ্ধ খনিজ ভাণ্ডার, সেই দেশটির অধিকাংশ মানুষকে কেন আধপেটা থাকতে হবে? স্বাধীনতার তিরিশ বছর কাটতে না কাটতেই, ১৯৯১ সালে সিয়েরা লিওনে শুরু হল প্রবল বিক্ষোভ। বিক্ষোভ, গৃহযুদ্ধে পরিণত হতে সময় লাগল না। দিকে দিকে জ্বলে উঠল আগুন। লক্ষ্য, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জোসেফ মোমাহকে গদিচ্যুত করা। ফলত, শুরু হয় সংগ্রাম। 

আরও পড়ুন
বাড়ির অমতেও ছাড়েননি নেশা, ৩০০০ শব্দছক তৈরি করে রেকর্ড বাংলার ‘পাজল-ম্যান’-এর

১৯৯১ থেকে ২০০২— দীর্ঘ ১১ বছরের এই যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় সিয়েরা লিওনের পরিকাঠামো। ৫০ হাজারের মতো মানুষ মারা যান, পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। বলা ভালো, একটা দেশ প্রায় শেষ হয়ে যায়। হয়তো সত্যিই শেষ হয়ে যেত, যদি না রাষ্ট্রসংঘ দায়িত্ব নিত। সমস্ত চেষ্টা যখন বিফলে যাচ্ছে, তখনই আসরে নামলেন তাঁরা। বিপুল সংখ্যায় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত এল রাষ্ট্রপুঞ্জ। তবে যুদ্ধ করতে নয়; যুদ্ধ মোকাবিলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায়। আর এই পর্যায়ই জন্ম হয় এক রূপকথার। যার মূলে ছিল বাংলা ভাষা…

আরও পড়ুন
“বেঙ্গলি নয়, ভাষাটাকে চিনি ‘বাংলা’ হিসেবেই”, হেসে উঠলেন ‘নোবেলজয়ীর শিল্পী’ নিকলাস

রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই বিশেষ সেনাবাহিনীর অনেকে ছিলেন বাংলাদেশি। এক দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে, এবং সেটাকে টিকিয়ে রেখেছে। আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে পৌঁছে সেই দেশটিকেও বাঁচানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলেন তাঁরা। কখনও বিদ্রোহ দমন, সরকারি-বিদ্রোহী বাহিনীদের মোকাবিলা করা, বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করা, সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া— সমস্ত কিছুই সামলাতে লাগলেন তাঁরা। সেই প্রচেষ্টার ফলেই ২০০২ সালে থেমে যায় গৃহযুদ্ধ। শান্তি ফিরে আসে সিয়েরা লিওনে। তারপরও তিন বছর সেখানে থেকে যান বাংলাদেশি সেনারা। শুধু শান্তি আসা তো নয়; দেশের ভেঙে পড়া পরিকাঠামোকেও তো সতেজ করতে হবে। সবার মনে বিশ্বাস আনতে হবে। ভেবে দেখুন, নিজের দেশ নয়। তবুও এত আন্তরিকভাবে সবাইকে মেলানোর প্রচেষ্টা চলছিল সেখানে। শান্তি আসার পথ তো এমনই হয়…

আরও পড়ুন
সনাতনী বাংলা থেকে আলাদা করতে হবে 'বাংলাদেশি' ভাষা! চর্চা চলল বর্ণপরিচয়-স্রষ্টার জন্মদিনেই

এই পুরো পর্যায় আরও কিছু ঘটনা ঘটে যায়। দীর্ঘদিন সিয়েরা লিওনে থাকার ফলে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে বাংলাদেশি সেনাদের। যখনই এমন যোগাযোগ তৈরি হয়, তখনই অনেক কিছু আদানপ্রদান চলতে থাকে। ইংরেজি ভাষা তো প্রচলিত ছিলই; কিন্তু বাংলাদেশি সেনারা সেখানে ঢুকিয়ে দেন আরও একটি জিনিস— বঙ্গ সংস্কৃতি। বাংলা ভাষা, তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ধারার সঙ্গে পরিচিত হন সিয়েরা লিওনের বাসিন্দারাও। ধীরে ধীরে তাঁরা আপন করে নেন বাংলাকে। এমনকি, বাংলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানও সেখানে আয়োজন করা শুরু হয়। সেই সেনাদলে আরও অনেক দেশ ছিল; কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত প্রভাব বিস্তার করতে বোধহয় কেউ পারেনি। যুদ্ধশেষে সেনারা চলে গেলেও, চলে যায়নি বাংলা ভাষা। একেবারে সমূলে গেঁথে যায় বহু মাইল দূরে, আফ্রিকার ওই অখ্যাত দেশে।

২০০২ সাল। সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি হয়। সেই বছরেই ১২ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা একটি ঘোষণা করেন। সেই দিন থেকে, সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্থান পায় বাংলা ভাষা। তৈরি হল আরও একটি ইতিহাস। এর আগে এভাবে একটি ভাষা, তার সংস্কৃতিকে সম্মান জানানো হয়নি। বাংলা ভাষা সেই বিরল কৃতিত্ব অর্জন করল। সিয়েরা লিওনের মানুষেরাও নেচে উঠল বাংলা গানে। বাংলা ভাষায় মেতে উঠলেন সেই দিন থেকে। আজও তার অন্যথা হয় না। আজও বাংলা ভাষা সেখানকার অন্যতম সরকারি ভাষা। এখনও খারাপ সময় কাটেনি সিয়েরা লিওনের। অনেক মানুষ আজও ঠিকমতো খেতে পান না। অথচ সম্পদের কমতি নেই সেখানে। তবুও আশা ছাড়েননি তাঁরা। বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষেরা তাঁদের সেই আশা দেখিয়েছে।

তথ্যসূত্র -
১) ‘সিয়েরা লিওন: আফ্রিকার যে দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা বাংলা’, জিনাত জাহান খান, রোর বাংলা
২) ‘যেভাবে বাংলা হল সিয়েরা লিওনের সরকারি ভাষা’, কালের কণ্ঠ 

Powered by Froala Editor

More From Author See More