আর্থিক অসঙ্গতির সঙ্গে লড়াই চলত নিত্যদিন। পাঁচ জনের সংসারে দু’বেলা অন্নসংস্থান করাও ছিল দুরূহ ব্যাপার। বেসরকারি বাস চালিয়ে আর কতই বা আয় হয়? তার ওপরে তিন সন্তানের পড়াশোনার ভার। তাই একদম ছোট্ট বয়সেই মাসির বাড়িতে রেখে এসেছিলেন তাঁর বাবা। সেখানেও পদে পদে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াত অনটন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের ক,থা শুকনো মুড়ি খেয়েই ঘাম ঝরাতেন তিনি। তবে উদ্যম কমেনি এতটুকু। বরং দারিদ্র্যই আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল জেদ।
প্রণতি নায়ক। মেদিনীপুরের পিংলার সেই তরুণীই আজ ভারতে জিমন্যাস্টিকের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নিতে চলেছেন অলিম্পিকের মঞ্চে। দীপা কর্মকারের পর দ্বিতীয় কোনো ভারতীয় হিসাবে অলিম্পিকে জিমন্যাস্টিকের প্রতিনিধিত্ব করবেন বছর ছাব্বিশের বঙ্গতনয়া। যা এককথায় ঐতিহাসিকও বটে।
তবে খুব কিছু সহজ ছিল না লড়াইটা। আর্থিক দুরাবস্থার তো ছিলই। পাশাপাশি প্রান্তিক এলাকায় আধুনিক অনুশীলনের পরিকাঠামোই বা কোথায়? শুধু দু’চোখের স্বপ্নের ওপর ভর করেই এই উড়ান। তখন আর কতই বা বয়স? সাত কিংবা আট বছর। জিমন্যাস্টিকে হাতেখড়ি হয়েছিল স্কুলশিক্ষকের কাছেই। বছর কয়েকের মধ্যেই রাজ্যস্তরে নজরকাড়া পারফর্মেন্স মেলে ধরেছিলেন প্রণতি। জিমন্যাস্টিকে তাঁর এহেন প্রতিভা দেখে এগিয়ে আসেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনিই যোগাযোগ করেন সাই-এর সঙ্গে।
অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর কলকাতায় প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেও, মেলেনি হোস্টেল। ফলে, বাইরে বাড়ি ভাড়া করেই থাকতে হত তাঁকে। আর থাকার খরচ? অর্থ জোগাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলনের পর বাড়ি ফিরে পরিচারিকার কাজ। মালিকের ঘর মুছে দেওয়া, বাসন মেজে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই। তবে এসবের মধ্যেও জাতীয় মিটে স্বর্ণপদক নিয়ে আসেন প্রণতি।
আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় সাঁতারু হিসাবে সরাসরি অলিম্পিকে সজন প্রকাশ
তারপরই বিষয়টি সাই কোচ মিনারা বেগমের নজরে আসে। তিনিই প্রণতিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখেন। বলা যায় সন্তানস্নেহেই তরুণী তারকাকে লালন করেছেন তিনি। নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন অনুশীলন থেকে প্রণতির পড়াশোনার দায়ভার। পরবর্তীতে তাঁকে হোস্টেলের ব্যবস্থাও করে দেন মিনারাই। তাঁর পরিচর্যাতেই ক্রমশ উজ্জ্বল হয়েছে প্রণতি। শুধু জাতীয় স্তরেই নয়, তৃতীয় ভারতীয় জিমন্যাস্ট হিসাবে তাঁর ঝুলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক পদকও।
আরও পড়ুন
অলিম্পিকের প্রথম রূপান্তরকামী অ্যাথলিট, ইতিহাস গড়ার পথে লরেল হুবার্ড
অন্যদিকে বদলেছে সময়ও। জিমন্যাস্টিকের দৌলতে বর্তমানে তাঁর চাকরিও মিলেছে ভারতীয় রেলে। তবে পিছু ছাড়েনি প্রতিবন্ধকতা। আঠারো বছর ধরে যে মানুষটার কাছে অনুশীলন করা, অগ্নিপরীক্ষায় তাঁকেই পাশে পাচ্ছেন না প্রণতি। ২০১৯ সালেই সাই থেকে অবসর নিয়েছিলেন মিনারা বেগম। আর সেই কারণেই টোকিও সফরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া যাবে না বলেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে সাই। বিতর্কের জায়গা থেকে যাচ্ছে সেখানেই। কারণ এর আগে অবসরগ্রহণ সত্ত্বেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এবং এশিয়ানেও কোচ হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তবে হঠাৎ কেন কোচ-পরিবর্তন? থেকে যাচ্ছে সেই প্রশ্নই।
আরও পড়ুন
উইম্বলডন, অলিম্পিকের মঞ্চ থেকে সরে দাঁড়ালেন নাদাল; হতবাক বিশ্ব
অন্যদিকে মহামারীর কারণেও দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল অনুশীলন। অলিম্পিকে নামার আগে মাত্র ২ মাস অনুশীলন করার সময় পেয়েছেন প্রণতি। অলিম্পিকের দোরগোড়ায় এসে অনুশীলনের জন্য চোট যাতে না লাগে, সেই কথাও মাথায় রেখেই চলতে হচ্ছে তাঁকে। তবে এতটুকু খামতি নেই তাঁর লড়াকু মেজাজে। ফোনেই পরামর্শ নিচ্ছেন প্রাক্তন অলিম্পিয়ান দীপা কর্মকার এবং কোচ মিনারা বেগমের থেকে। ৩৬০ ডিগ্রি ফ্রন্ট আর ব্যাকভল্টই এখন হাতিয়ার তাঁর। এখন দেখার অলিম্পিকে মঞ্চে তিনি নতুন কোনো ইতিহাস তৈরি করতে পারেন কিনা। সে উত্তর সময়ই দেবে। আপাতত নিজের সেরাটুকু উজাড় করে দেওয়ার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছেন বঙ্গতনয়া…
Powered by Froala Editor