ফটোগ্রাফি মানে তাঁর কাছে শুধুই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য তুলে রাখা নয়। সেইসমস্ত ছবির কাব্যমূল্য থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবন তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব। এমনটাই মনে করেন পৌলমী বসু। তাঁর কথায়, আলোর সঙ্গে যেখানে অন্ধকার হাত ধরে চলে, সেখানেই দৃশ্য খুঁজতে চান তিনি। ইংল্যান্ড প্রবাসী এই বাঙালি আলোকচিত্রী এবারের আন্তর্জাতিক দিউৎসে বোর্স ফটোগ্রাফি পুরস্কারের অন্যতম দাবিদার। আর এই মনোনয়নের পিছনে রয়েছে তাঁর সাম্প্রতিক ডকু-ফিকশন ‘সেন্ট্রালিয়া’।
‘সেন্ট্রালিয়া’ মূলত মধ্যভারতের আদিবাসী জীবনের উপর নির্মিত একটি ডকু-ফিকশন মুভি। তবে তার মধ্যে বেশিরভাগ উপাদানই স্থিরচিত্র। নানা সময়ে জঙ্গলমহলের নানা স্থান থেকে সংগৃহীত এইসমস্ত ছবি গেঁথে গেঁথে তিনি একটি বাস্তব গল্প বলে গিয়েছেন। যে গল্প বিদেশে তো বটেই, ভারতীয়দের কাছেও সম্পূর্ণ পরিচিত নয়। পরিকল্পনাটা এসেছিল প্রায় বছর দশেক আগে। পৌলমী বসু তাঁর বাবার কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে কয়েকটা ছবি খুঁজে পান। আর সেইসঙ্গে কিছু রাজনৈতিক দলিল। উত্তাল সত্তরের দশকে নকশালপন্থীদের সাহায্য করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁর বাবা।
আপাতভাবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়াও যে নকশাল-মাওবাদী আন্দোলনের অন্য কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে, তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। পৌলমীও কোনোদিন ভেবে দেখেননি। কিন্তু বাবার সেই অসম্পূর্ণ দলিল পড়তে পড়তেই তাঁর সামনে নানা মাত্রা খুলে যেতে থাকে। এই আন্দোলনের সঙ্গে নারীবাদী এবং পরিবেশপন্থী আন্দোলনের নিবিড় যোগসূত্র খুঁজে পান। আর এর পরেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। জঙ্গলমহলের নানা আদিবাসী গোষ্ঠী এবং মাওবাদী সংগঠনের সাক্ষাৎকার নিতে থাকেন। সেইসব সাজিয়েই তৈরি করেছেন এই ডকু-ফিকশন।
মাওবাদী আন্দোলন নিঃসন্দেহে একটি উগ্রপন্থী কমিউনিস্ট আন্দোলন। কিন্তু এটুকুই এই আন্দোলনের শেষ পরিচয় নয়। ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, নিপীড়িত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের আত্মসম্মানের লড়াই তো বটেই। আবার অরণ্যের অধিকারেরও লড়াই। জঙ্গল ধ্বংস করে যখন নানা কোম্পানি এসেছে শিল্পায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে, তখন মাওবাদী নেতৃত্বের হাত ধরেই প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন অরণ্যবাসী মানুষ। আর এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে এগিয়ে এসেছেন মহিলারাই। তাই তার সঙ্গে নারীবাদী আন্দোলনেরও নিবিড় যোগাযোগ আছে বলেই মনে করেন পৌলমী বসু। তিনি শুধু চান, নিছক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে এই আন্দোলনের নানা বৈচিত্র সম্বন্ধে মানুষ জানুক। উঠে আসুক প্রকৃত সত্য।
আরও পড়ুন
হুইলচেয়ারে বসেই ফটোগ্রাফি, ক্যামেরাকে সঙ্গী করে প্রতিবন্ধকতা জয় খড়গপুরের শুভ্র-র
আর কিছুদিনের মধ্যেই লন্ডন ফটোগ্রাফার্স গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে প্রদর্শনী। পৌলমী বসুর এই ডকু-ফিকশনের সঙ্গেই প্রদর্শিত হবে দিউৎসে বোর্স প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত আরও ৩ জন আলোকচিত্রীর পৃথক পৃথক প্রকল্প। শেষ পর্যন্ত কি পুরস্কৃত হবেন পৌলমী? তা নিয়ে অবশ্য খুব বেশি ভাবিত নন তিনি। আন্তর্জাতিক স্তরে তিনি বাংলার একটি রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছেন। এটুকুই তাঁর কাছে বিরাট সাফল্য।
আরও পড়ুন
দেশের প্রথম ফটোগ্রাফিক স্টুডিও কলকাতাতেই; ১৫৩ বছরের যাত্রায় দাঁড়ি টেনেছিল অর্থাভাব
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি – হুজুগ, নিষ্ঠা ও কিছু বিপন্ন বন্যপ্রাণের গপ্পো