বয়স হয়েছিল মাত্র ৬০ বছর। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই জীবনের সিনেমায় পরিসমাপ্তি ঘোষণা করলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা কিম কি-দুক। জানা যায়নি তাঁর অসুস্থতার খবরও। তারপর যে আকস্মিকই সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েই মৃত্যুসংবাদ। এক প্রকার অবিশ্বাস্য। দক্ষিণ কোরিয়ান এই কিংবদন্তির চলে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক-সিনেমায় বিরাট শূন্যস্থান তৈরি হল, তাই উঠে এল বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য’র কথায়।
“ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে আমার মতো যাঁরা ছবি করতে এসেছেন অন্য একটা কর্মক্ষেত্র থেকে; সেখান থেকে ডেভিয়েট করে সিনেমার জগতের সঙ্গে যে ভালোবাসাটা তৈরি হয়েছে সেটাই কিছু মানুষের জন্য। এবং তিনি তার মধ্যে অন্যতম একজন মানুষ। আমার জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছেন এমন দশজন পরিচালকের নাম বলতে বলা হয়, তার মধ্য আসবে ওঁর নাম। এবং ওঁর ছবি দেখে এক কথায় ‘মুগ্ধতাই’ বলা যায়”, বলছিলেন ইন্দ্রাশিস আচার্য।
সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে দৃশ্যপটের সঙ্গে কোনোরকম আপস করতেন না কিম কি-দুক। সাহসিকতার সঙ্গেই বারবার তুলে ধরেছেন নৃশংসতাকে। তাঁর সিনেমায় বারবার ধরা দিয়েছে এক অন্য বাস্তবতা। যা শুধু দর্শকদের নয়, ভাবিত করেছে অন্যান্য চলচ্চিত্র পরিচালকদেরও। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে বাংলা সিনেমাকে কতটা প্রভাবিত করেছেন তিনি? ইন্দ্রাশিসবাবু জানালেন, “বাকিদের কথা তো বলতে পারব না, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই প্রভাবিত। আমার সিনেমা দেখার মাঝপথে এসে পুরো সিনেমার ধারণাই উনি পাল্টে দেন। যখন সাউথ এশিয়ান বা এশিয়ান সিনেমা নিয়ে কথা ওঠে তখন অনেকেই বলেন, যে ওঁর ছবি খুব ওরিয়েন্টালিজমের পক্ষপাতিত্ব করে। তো সেখান থেকেই আমাদের তর্ক শুরু হয়। যদি ওঁর ছবির ধরণ দেখা যায়, প্রথমে যে পোয়েটিকভাবে উনি শুরু করেছিলেন স্প্রিং সামার ফল উন্টার এন্ড স্প্রিং দিয়ে, তারপর থ্রি-আয়রন, বো, পিয়েতা— ক্রমশ ব্রুটালিট বাড়তে থাকে ওঁর ছবিতে। মানব সভ্যতার একটা চরম বিরোধী জায়গায় চলে গিয়েছিলেন উনি। তবে ওঁর মতো ডিরেক্টরদের প্রভাব থাকলে ছবি করাটা খুব মুশকিল হয় কারণ, যে ফ্রেম ওঁরা ইউজ করেন হয়তো আর্থ-সামাজিকভাবে আমরা সেই ছবি হয়তো করতে পারব না বা আমরা সেভাবে ভাবি না। সেখানে বেশ কিছু কনস্ট্রেন চলে আসে।”
তবে একাধিক বিতর্কের সঙ্গে কিম কি-দুকের নাম জড়িয়ে থাকলেও তরুণদের তৈরি সিনেমার ব্যাপারে চিরকালই আগ্রহ ছিল তাঁর। ব্যক্তিগত আলাপে এক অন্য কিম কি-দুককেই চিনেছিলেন ইন্দ্রাশিস আচার্য। কথায় কথায় সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সম্পর্কেই তিনি জানালেন, “আমার সঙ্গে লানমেই ফিল্ম উইকে ওঁর পরিচয় হয়েছিল। ২০১৮ সালে। আমি ‘পিউপা’ দিয়েছিলাম। আর ওঁর ছবি সম্ভবত ‘পিয়েতা’ ছিল। ঠিক মনে নেই। আমার ছবি দেখে ওঁর ভালো লেগেছিল। আমাকে বলেছিলেন, ছবি করার সময় কোনো কিছু নিয়ে ভেব না। একজন ঠিকঠাক লোকের হাতে পড়া দরকার কোনো ছবির। সময় লাগতে পারে, কিন্তু ছবি নিজে নিজেই পথ খুঁজে নেয়। ভালো ছবি যদি হয় সেটা। তো আর পর থেকে উনি বলতেন আরকি যে আমি ছবি করলে যেন ওনাকে পাঠাই। এবং আমি ছবি মেল করলে উনি উত্তর দিতেন। এবং এমন নয় যে উনি ইগনোর করতেন। প্রতিটা মেলেরই তিন-চার দিনের মধ্যেই উনি উত্তর দিতেন। এবং ছবিগুলো দেখে তবেই অভিমত জানাতেন।”
তবে শুধুই কি ইন্দ্রাশিস আচার্য? একুশ শতকে ছবি করতে আসা এমন অনেক চলচ্চিত্র পরিচালকদেরই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পথ শুরু হয়েছিল কিম কি-দুকের সিনেমা দেখেই। অনেক তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাছেই হয়ে উঠেছিলেন আইকন। বলাইবাহুল্য দূরত্ব রেখে চলতেন না কখনোই। বরং তাঁদের ছবির প্রতি ব্যক্তিগত অভিমত জানাতেন কিম কি-দুক। যেন বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে ছিলেন একজন অভিভাবকই। কিম কি-দুকের চলে যাওয়ায় ফাঁকা হয়ে গেল সেই জায়গাটাই। শুধু রয়ে গেল তাঁর তৈরি করা সিনেমাগুলি আর সেলুলয়েড পর্দায় সাহসিকতাকে ফুটিয়ে তোলার কিছু উদাহরণ...
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
আবারও নক্ষত্রপতন, চলে গেলেন দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা কিম কি-দুক