“আমি বাণিজ্যিক বা অ-বাণিজ্যিক ছবির বিভাজনে বিশ্বাস করি না। কেউ সিনেমা বানান সিনেমা-নির্মাতা হয়ে ওঠার জন্য, আর কারোর সিনেমা না বানিয়ে উপায় থাকে না। আমি এই দ্বিতীয় বর্গের মধ্যে থাকতেই ভালোবাসি।” বলছিলেন পরিচালক অভিনন্দন ব্যানার্জি। যাঁর সিনেমা এবছর পাড়ি দিতে চলেছে এস্টোনিয়ার তালিন শহরে। নভেম্বর মাসের গোড়াতেই তালিন ব্ল্যাক নাইটস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হবে অভিনন্দনের ‘মানিকবাবুর মেঘ’। আর এটিই পরিচালকের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘের সিনেমা। তালিনেও এবছরের বিশ্বব্যাপী প্রথম পূর্ণদৈর্ঘের ছবির প্রতিযোগিতাতে রয়েছে ছবিটি।
ছোটো পত্রিকার সম্পাদনা ও লেখালেখির মধ্যে দিয়ে ছাত্র জীবনে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ অভিনন্দনের। পরে সিনেমার জগতে যাত্রা শুরু আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে। সিনেমাকে তিনি দেখেছেন শিল্পের আরেকটি মাধ্যম হিসাবে। এভাবেই প্রায় ২ বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলেন ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এর চিত্রনাট্য। পরে আরও প্রায় দু-বছর কেটে গেছে নির্মাণে। তবে সিনেমার কাহিনির কথা জানতে চাইলেই একটু অস্বস্তিতে পড়েন তিনি। শেষ পর্যন্ত বলেন, “এই সিনেমায় প্রচলিত অর্থে গল্প বলতে যা বুঝি সেরকম কোনও গল্প নেই নেই। গল্পকেন্দ্রিক সিনেমাতেও আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু এই সিনেমা গল্পমুখী নয়।” সত্যিই তো, সিনেমা মানেই তো গল্প নয়। বরং টুকরো টুকরো কিছু দৃশ্যকে সাজিয়ে তোলা এবং এক সুতোয় গেঁথে তোলাই তো সিনেমার কাজ। এই সিনেমাতেও সেই দৃশ্যগুলিকে গেঁথেছে এক প্রেমের আবহ। সেখানে নাগরিক একাকিত্বে ভুক্তভোগী মানিকবাবুকে সারাক্ষণ অনুসরণ করে চলেছে একটি মেঘ। তবে এ যেন আরেকটি প্রেমের গল্পও নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ও প্রকৃতি মিলেমিশে তৈরি হওয়া বাস্তুতন্ত্রের ছবি। মূর্ত পৃথিবীর বুকে এক বিমূর্ত পৃথিবীর ছবি।
সিনেমায় মানিকবাবুর চরিত্রে দেখা যাবে প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেনকে। তাঁর সঙ্গে থাকছেন ব্রাত্য বসু, নিমাই ঘোষ, দেবেশ রায়চৌধুরীর মতো নাটকের জগতের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের। ২০২০ সালেই সিনেমার জগত থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন অরুণ গুহঠাকুরতা। অভিনন্দনের সিনেমা তাঁকেও বন্দি করে রেখেছেন আগামীর দর্শকদের জন্য। সব মিলিয়ে সিনেমাটি একেবারেই ছকভাঙা সিনেমা। অভিনন্দনের প্রথম পরিচালনার পাশাপাশি এটি পূর্ণ দৈর্ঘের ছবির প্রযোজক রূপে বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়-এরও প্রথম ছবি। মোনালিসা মুখোপাধ্যায়ের সাথে যুগ্ম ভাবে এই ছবির প্রযোজনা করেছেন তিনি। প্রথম ছবিতেই সবাই মিলে এমন একটি চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, যাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই।
আর শেষ পর্যন্ত সাফল্যও মিলেছে। গত জানুয়ারিতেই এনএফডিসি ফিল্ম বাজার-এ বিশেষ গোত্রের সিনেমা হিসাবে মনোনীত হয়েছিল ‘মানিকবাবুর মেঘ’। তারপর থেকে শুরু হয়েছে ছবিটির আন্তর্জাতিক যাত্রা। আর এবার তালিনে সারা পৃথিবীর দর্শকদের সামনে প্রদর্শিত হতে চলেছে সিনেমাটি। কিন্তু বাঙালি দর্শক কবে দেখবেন সিনেমাটি? অভিনন্দনের উত্তর, “আমাদের মতো স্বাধীন পরিচালকদের হাতে এই বিষয়টি সবসময় থাকে না। তবে ইউরোপে স্ক্রিনিং এর পর হয়তো অনেকেই সিনেমাটি দেখাতে আগ্রহী হবেন। বিদেশের মাটিতে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হলেও, যে ভাষায় আমার সমস্তকিছু, যেখানে এই সিনেমার শিকড়, সেখানকার মানুষকে আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘের সিনেমা দেখানোর ইচ্ছা তো থাকবেই। আমরা চেষ্টা করবো যত শীঘ্র সম্ভব বাংলা ও বাঙালির কাছে এ ছবি পৌঁছে দেওয়া যায়।” অভিনন্দনের আশা, হয়তো আগামী বছরের মধ্যেই কলকাতায় কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে বা অন্য কোনোভাবে প্রিমিয়ারের ব্যবস্থা করা যাবে। আর তার আগে তালিনের ব্ল্যাক নাইটস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ২৫ তম বর্ষের ফার্স্ট ফিচার কম্পিটিশনে একমাত্র ভারতীয় সিনেমাটি সেখানে দর্শকদের মন জয় করে নেবে, এই আশা করাই যায়।
Powered by Froala Editor