নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক সেটা। ১৯৯২-’৯৩ সাল। এক লহমায় বদলে গিয়েছিল দেশের পরিস্থিতি। মুম্বাই বিস্ফোরণ এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংস— বর্বরোচিত দুটি ঘটনায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল সমাজের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূল বুনিয়াদ। বদলে গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল হিংসার আবহ। স্রেফ অবিশ্বাস আর প্রতিহিংসার বশে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন অনেকে। প্রাণ গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের। সেই হিংসার রেশ পড়েছিল বাংলাতেও। কোপ পড়েছিল খুদেদের মননে। এই অস্থির পরিস্থিতিরই শিকার হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের প্রত্যন্ত এক গ্রামের দুই বছর আটেকের কিশোর। দু’জন ভিন্নধর্মী— একজন ব্রাহ্মণ, অন্যজন মুসলমান। সাম্প্রদায়িকতার খেলা শৈশবের সেই বন্ধুত্বের মধ্যেই তুলে দেয় চিরস্থায়ী কাঁটাতার।
না, কোনো বাস্তব ঘটনা নয়। বরং, বাস্তবতাকে সামনে রেখেই দুই বন্ধুর এই আখ্যান নির্মাণ করেছিলেন বাঙালি পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায় (Prasun Chatterjee)। ক্যামেরার লেন্সে ধরতে চেয়েছিলেন বাংলার অস্থিতিকর সেই অধ্যায়ের পটভূমি। আর নব্বইয়ের সেই দৃশ্যপট ফুটিয়ে তুলতে যে তিনি একশো ভাগ সফল, তার প্রমাণ মিলল আবারও। এবার সাগর পেরিয়ে ব্রিটেনে পাড়ি দিচ্ছে প্রসূনের তৈরি ‘দোস্তজি’ (Dostojee) সিনেমাটি। সম্প্রতি, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত ৬৫তম লন্ডন আন্তর্তাজিক চলচ্চিত্র উৎসবে (London Film Festival) জন্য নির্বাচিত হয়েছে বাঙালি পরিচালকের এই চলচ্চিত্র। ১৯৬০ সালে এই চলচ্চিত্র উৎসবেই প্রিমিয়ার হয়েছিল সত্যজিতের ‘অপুর সংসার’-এর। ‘দোস্তজি’-র ব্রিটেনপাড়ি যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ইতিহাসকেই। আগামী ১২ অক্টোবর এই সিনেমার প্রিমিয়ার হবে সাউথ ব্যাঙ্কে। উল্লেখ্য, এটিই প্রসূনের তৈরি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘের ছবি।
ছবির গুণগত মান, প্রাসঙ্গিকতা, দৃশ্যের চিত্রায়ণ— এসব নিয়ে তো আলোচনা হয়ে থাকে সকল সিনেমারই। তবে যা একেবারেই আলোর আড়ালে থেকে যায়, তা হল নির্মাণের গল্প। ‘দোস্তজি’-র আসল সাফল্য যেন লুকিয়ে রয়েছে সেই জায়গাটাতেই। ২০২১ সালে ছবির কাজ সম্পূর্ণ হলেও, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল প্রায় আরও ৬ বছর আগে। ২০১৩ সালে। প্রসূনের জন্ম এবং বেড়া ওঠা কলকাতার পার্শ্ববর্তী দমদমেই। কিন্তু ছবি নির্মাণের জন্য প্রায় দীর্ঘ এক বছর তিনি কাটিয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানেই তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন গল্পের স্ক্রিপ্ট।
“মুর্শিদাবাদের লাস্ট সাবডিভিশন হচ্ছে ডোমকল। মাঝে পদ্মা। ওপারে বাংলাদেশের রাজশাহী। দোস্তজিতে দুই বন্ধুর চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন, ডোমকলের মূল সাবডিভিশন থেকে আরও ১২-১৩ কিলোমিটার ভেতরে ভগীরথপুর বলে একটি গ্রামে তাদের বাড়ি”, বলছিলেন প্রসূন। সিনেমাটির শ্যুটিং গোটা ডোমকলজুড়ে হলেও, ভগীরথপুরে থেকেই প্রান্তিক জনজীবনের মূল্যায়ন করেছেন বাঙালি পরিচালক। খুঁজেছেন ইতিহাসের ঢেকে যাওয়া গল্প, ক্ষতদাগ।
আরও পড়ুন
কেরিয়ারে একের পর এক আন্তর্জাতিক সিনেমা, বাংলায় তবু 'ব্রাত্য' ভিক্টর!
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্রের বাড়িতে ব্লু প্লেক, তৈরি হবে প্রদর্শনশালাও
ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছে দুই কিশোর আসিক শেখ ও আরিফ শেখ। তারাও সেলুলয়েড স্ক্রিনে এই প্রথমবার। আরও ভালো করে বলতে গেলে, এই প্রথম কোনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো তাদের। “শ্যুটিং-এর প্রসেসটা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সাল নাগাদ থেকে। অভিনেতাদের তৈরি করে নিতেও তো একটা সময় লাগে। আসলে অঞ্চলটাই প্রচণ্ড আন্ডারপ্রিভিলেজড একটা জায়গা। ওরাই ওদের পরিবারের প্রথম প্রজন্ম যে স্কুলে যাচ্ছে। কোনোদিন স্টিল ফটোগ্রাফির ক্যামেরাও দেখেনি ওরা। ফলে, নিজেদের তৈরি হওয়া এবং ওদের তৈরি করা— সেটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিল। মূল বিষয়টা ছিল, এমন একটা বন্ধুত্ব তৈরি করা যাতে স্কুলে শিক্ষকের থেকে বকা খেলে আমার কাছে নালিশ করতে পারবে, সমবয়সী কোনো বান্ধবীকে ভালো লাগলে আমাকে এসে বলতে পারবে। আমার সঙ্গে সেই প্রসেসটাই চলেছে দীর্ঘদিন ধরে”, প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের কথা শুনতে শুনতে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় যে কাউকেই। বাকরুদ্ধ হতে হয় তাঁর নিষ্ঠার কাছেও। শুধু আসিক ও আরিফই নয়, ‘দোস্তজি’-র অধিকাংশ অভিনেতাই মুর্শিদাবাদের স্থানীয় বাসিন্দা। তাছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন কলকাতা, বালুরঘাট, বহরমপুর এবং নদীয়ার থিয়েটার অভিনেতারা।
আরও পড়ুন
প্রথম চলচ্চিত্রের আগেই বানিয়ে ফেলেছিলেন পঞ্চাশেরও বেশি ছবি!
বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তুহিন বিশ্বাসের কথাও। তাঁর লেন্সেই ধরা পড়েছে প্রান্তিক বাংলার মায়াময় দৃশ্য। নদিয়ার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক তুহিন স্থিরচিত্রসংগ্রাহক হলেও সিনেম্যাটোগ্রাফার হিসাবে এটাই প্রথম কাজ তাঁর। ইতিমধ্যেই একাধিক আন্তর্জতিক পত্র-পত্রিকায় প্রশংসিত হয়েছে তাঁর কাজ। বলার অপেক্ষা থাকে না, এই ছবির অন্যতম রূপকার তিনিও।
তবে চলচ্চিত্রটি তৈরির মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল অর্থ। কথায় কথায় প্রসূন জানালেন, ২০১৭ সালে প্রথমে একটা ছোটো করে শ্যুটিং করেছিলেন ক্রাউড ফান্ডিং-এর জন্য। একটা ছোটো ট্রেলার বের করেছিলেন সেসময়। তাতে সাড়াও মিলেছিল খানিকটা। কিন্তু একটা আস্ত ফিচার ফিল্ম তৈরির জন্য তা উপযুক্ত ছিল না কখনোই। পরে ‘দোস্তজি’ ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস সিনেমা হিসাবে মনোনীত হয় এনএফডিসি ফিল্ম বাজারে। সেখানেই প্রথম আন্তর্জাতিক এক্সপোজার পায় দুই বন্ধুর গল্পটি। প্রসূনের কাজ দেখে প্রযোজনায় আগ্রহী হন তাইওয়ানের প্রযোজক আইভি ইউ-হুয়া। এগিয়ে আসেন কলকাতারও দুই প্রযোজক প্রসেনজিৎ রঞ্জন নাথ ও সৌম্য মুখোপাধ্যায়। তারপর শুরু হয় মূল পর্যায়ের শ্যুটিং। জানা গেল, ২০২১ সাল পর্যন্তও চলেছে সিনেমার পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ।
এর আগে গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোস টু কান’ বিভাগেও নির্বাচিত হয়েছিল প্রসূনের তৈরি ছবিটি। তাঁর তৈরি সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘেরর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও। এবার মুকুটে জুড়ল আরও একটি পালক। আগামীতেও একাধিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদৃত হবে ‘দোস্তজি’, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে বঙ্গসন্তানের চূড়ান্ত সাফল্য ছুঁয়ে ফেলা হয়তো হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। এই সিনেমার নির্মাণে…
Powered by Froala Editor