কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এসে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন ঋতুপর্ণকে। একজন তথ্যচিত্র নির্মাতার চরিত্র। তিনি নিজে রূপান্তরকামী মানুষ, তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন চপল ভাদুড়িকে নিয়ে। এমন লোভনীয় চরিত্রে ‘না’ বলতে পারেননি ঋতুপর্ণ। কিন্তু, তাঁর জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। কৌশিক হঠাৎ বলে উঠলেন, “ঋতুদা, তুমি তোমার শহুরেপনাটা একটু কমাতে পারবে?”
দিল্লিবাসী, আধুনিক তথ্যচিত্র-নির্মাতার তো শহুরে হওয়ারই কথা! তাহলে? কৌশিক খোলসা করেন পুরো বিষয়টা — “তা হলে চপলদার যৌবনের অংশগুলোও তোমায় দিয়ে করাব, ভাবছি।”
এমন চ্যালেঞ্জ না নিয়ে থাকা যায় না। কিন্তু, শহুরেপনা কমানো বলতে ঠিক কী চাইছেন কৌশিক? আধুনিকতা কমাতে বলছেন কি? ঋতুপর্ণর প্রশ্নের উত্তরে কৌশিক বলেছিলেন, “তোমার একটা শহুরে সফিস্টিকেশন আছে, সেইটার কথা বলছিলাম।”
শুনে হয়তো একচিলতে হেসেছিলেন ঋতুপর্ণ। তারপর বলেছিলেন, “ভাবিস না। ওটা পুরোপুরি এক্সটার্নাল। ঝেড়ে ফেলতে দু’-মিনিটও লাগবে না।”
নিজের বাহ্যিক শহুরে সফিস্টিকেশন ঝেড়ে ফেলতে সময় লাগেওনি তাঁর। যৌবনের চপল ভাদুড়ি আর তথ্যচিত্র-নির্মাতা চরিত্র—দুটিতেই তিনি অভিলিপ্ত হয়েছিলেন অনায়াসে। চরিত্রের প্রয়োজনে ওজন কমিয়েছিলেন অনেকখানি। ‘অ্যাবডোমিনোপ্লাস্টি’ করিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছিল, এসব আসলে ছবি করার ছুতোয় নিজেকে সাজিয়ে নেওয়া। ঋতুপর্ণ উচ্চকিত প্রতিবাদ করেননি। শুধু বলেছিলেন, সেসব “চরিতার্থতার জন্য আমার কোনও ছবির ছুতো লাগে না—আমার ইচ্ছেটাই যথেষ্ট।”
নিজের ইচ্ছেতেই তো বেঁচেছেন ঋতুপর্ণ। সমাজ তাঁর দিকে কুৎসিত ইঙ্গিত ছুড়ে দিয়েছে, তাঁকে আরও কুৎসিত নকল করে সস্তার জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন বিখ্যাত সঞ্চালক। ঋতুপর্ণ সে-সব পাত্তাই দেননি। বরং, নিজের টক শো-তে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়েছেন সেই সঞ্চালককে। সেখানে তাঁর আপাত ঔদ্ধত্য যেন চাবুক হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের। তাঁর যৌনসত্তা, তাঁর লিঙ্গভাবনা নিয়ে তিনি অকপট। সমাজ তাঁকে প্রান্তিক করেও কোণঠাসা করতে পারেনি।
আর, নিজের অন্তরমহলে ঘটে চলা লিঙ্গ-রাজনীতি, যৌনতার এই অন্তর্ঘাতগুলোকে কিন্তু শহুরে সফিস্টিকেশনের মতো বাহ্যিক করে রাখেননি ঋতুপর্ণ। ‘বাড়িওয়ালি’র স্বপ্নদৃশ্যে তাই বড়ো সূক্ষ্ম সুতোয় বোনা হয়ে যায় সেইসব গল্পেরা। মেয়েলি পুরুষ প্রসন্ন ঘোমটা খুলে তাকায়। বাস্তবে না, স্বপ্নে। আবহতে তখন শোনা যাচ্ছে মনসা-ভাসানের গান। ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্নার মতো সুরে অকাল বৈধব্যের জ্বালা। কিন্তু, সাপের ছোবল কেবল মৃত্যুকেই নিশ্চিত করে না। সাপের গূঢ় প্রতীকার্থ যে অন্য, সেই সাপের ছোবলও যে কম প্রাণঘাতী নয়, তাও আমাদের মনে করিয়ে দেন ঋতুপর্ণ। ‘চিত্রাঙ্গদা’য় লিঙ্গ-যৌনতার এই পাঠ, চিহ্নায়ন আরও স্পষ্ট, নিবিড়, প্রত্যক্ষ। সে-ছবির পরিকল্পনা অবশ্য অনেক পরে।
ঋতুপর্ণর প্রথম সিনেমা ‘হীরের আংটি’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি। জীবনের শেষ ছবি, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র, ‘জীবনস্মৃতি’-ও মুক্তি পায়নি কোনও সিনেমাহলে। এমন আশ্চর্য সমাপতন বা দুর্ভাগ্য আর কোনও পরিচালকের জীবনে ঘটেছে কি? মাঝের ছবিগুলির জন্য ১১টি জাতীয় পুরস্কার, সঙ্গে আরও পুরস্কার। সেই ‘উনিশে এপ্রিল’ থেকে শুরু। যে-ছবির নাম মোটেই পছন্দ হয়নি অভিনেতা দীপঙ্কর দে-র। বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে বলশেভিক রেভোলিউশন নিয়ে ছবি হচ্ছে।” সামান্য বাজেটের সিনেমা। এক পয়সাও নেননি অপর্ণা সেন আর প্রসেনজিৎ। তিরানব্বই সালের ঊনত্রিশে ডিসেম্বর ‘উনিশে এপ্রিল’-এর সেন্সর হল আর একত্রিশে ডিসেম্বর বিজ্ঞাপনের চাকরি ছেড়ে দিলেন ঋতুপর্ণ। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে দশ বছরের গাঁটছড়া শেষ। ভাগ্যিস… 'উনিশে এপ্রিল' 'স্বর্ণকমল' পেয়েছিল।
এইসব সাফল্য আর পুরস্কার নিয়ে অবশ্য দার্শনিক নির্লিপ্তিতে পৌঁছতে পেরেছিলেন ঋতুপর্ণ। লিখেছিলেন, “যতই মেডেল জিতি না কেন—আমি কোনোদিন সত্যিকারের বড় চলচ্চিত্রকার হব না।” এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প শুনিয়েছিলেন তিনি। মুম্বইতে শ্যাম বেনেগালের বাড়িতে যাওয়ার পর তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছিল একটা রুপোর থালায়। ঋতুপর্ণ অবাক। শ্যাম বেনেগাল তখন জানান, তিনি যতগুলো ‘রজতকমল’ পেয়েছেন, সেগুলো গলিয়ে ফেলে থালা বানানো হয়েছিল। তাতেই খেতে দেওয়া হত অতিথিদের। থালার পিছনে লেখা ‘মন্থন’, ‘ভূমিকা’-র ছবির নাম।
ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন, “এটাই হয়তো বা শ্রেষ্ঠ উপায়। নিষ্ফলা সাফল্যের ব্যর্থতাকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।”
শিল্পীকে তাঁর বলতে চাওয়ার সবটুকুই ভাগ করতে হয় শিল্পের মাধ্যমে, ঋতুপর্ণ যেমন করে গেছেন আজীবন। দৃশ্য থেকে দৃশ্যে, আবহে… যা ভাগ করতে পারেননি, তা ভাগ করে নেওয়ার যোগ্য হয়ত আমরা ছিলাম না। তাঁর ‘নিষ্ফলা সাফল্য’গুলো অবশ্য আমাদের অনেক ফসল দেয় এখনও। এও তো এক রকম ভাগ করাই, তাই না?
ছবি ঋণ - indiatogether.org
Powered by Froala Editor