সমকালীন নাকি চিরকালীন! যে-কোনো মহৎ স্রষ্টার সামনে এসে এই যতিচিহ্নে খানিকটা থমকে দাঁড়াতে হয় উত্তরকালকে। আর ঠিক তখনই বোঝা যায়, শিল্পীর মহত্ত্ব। হৃদয়ঙ্গম হয়, কীভাবে সময়ে আশ্লিষ্ট থেকেও একজন শিল্পী সময়কে অতিক্রম করে যান। তথাপি তিনি প্রাসঙ্গিক থাকতে পারেন। এ-এক বিমূঢ় বিস্ময়। ভারতীয় চলচিত্রে যে-বিস্ময়ের মূর্তপুরুষ মৃণাল সেন।
সার্ত্রেকে দেওয়া এক অভিধার সূত্রে আমাদের চলচ্চিত্র-শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, মৃণাল ‘আত্মসচেতনভাবে সমসাময়িক’। সন্দেহ নেই এ-অভিধা তাঁর ক্ষেত্রে অমোঘ ও সুপ্রযুক্ত। যে-রাজনীতির দিনকাল আজ হয়তো বিবর্ণ অতীত, হলদেটে ইতিহাস অথবা কেবলই সচেতন আত্মবিস্মৃতি,- তাকে করমর্দন করেই যিনি জীবনের অন্বেষণে নামেন, তিনি যে সময়ের প্রতি গভীর এবং একান্তভাবে অনুগত, তা নতুন করে বলার কিছু নয়। কিন্তু এই আনুগত্যকেই, মৃণালের মতো শিল্পী, কেবল সময়ের ধারাবিবরণী করে ফেলে রাখেন না। বরং সময়ের ভিতর থেকে দ্বান্দ্বিক অভিব্যক্তি চিহ্নিত করে, তিনি সেই সময়কেই ফ্রেম থেকে বের করে দিতে পারেন। যে-রাজনীতিতে শিল্পী বিশ্বাস করতেন, সেই রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যে প্রেম ও অভিমান, দ্বন্দ্ব ও তর্ক, সহমত ও মতান্তর, তারই সন্দর্ভ করে তুলতে পারেন তাঁর শিল্পকে। এ-এক দ্বান্দ্বিক অবস্থান। নিজের সঙ্গেই নিরন্তর কথোপকথন। নিজের সত্তা, শ্রেণি, চ্যুতি, ত্রুটি, অবস্থান ও আত্মসমালোচনা ধারাবাহিক কোলাজ। তার প্রেক্ষিত নিশ্চিতই নির্দিষ্ট একটা সময়, কিন্তু কেবল নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিতেই তা বাঁধা নয়। ফলে মৃণাল সেন সেকালের এবং একালেরও।। কারণ, সময়ের গতিপথ আবার অতীতের অনুরূপ কোনও সময়ের কাছেই ফিরে আসে। অন্তত সময়কালের ব্যবধান সত্ত্বেও দুই সময়ের মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হতে থাকে। ইতিহাসের ঘূর্ণনক্রম এরকমই। দীপেন্দু চক্রবর্তী খুব সার্থকভাবেই তাই বলেন, “…যদি আবার কোনও মুক্তির দশক এসে হাজির হয় এবং আমাদের শিল্পচেতনাও যদি পরিণত হয়ে ওঠে তবে ‘সেই সময়ের’ মৃণাল সেন ও ‘এই সময়ের’ মৃণাল সেন কাউকেই আমরা খারিজ করতে পারব না।” এইখানেই একজন শিল্পীর মহত্ত্ব। উত্তরকাল বোঝে, মহৎ শিল্পী মাত্রই সমকালীন হয়েও চিরকালীন।
মৃণাল সেনের এই যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, নিশ্চিত তা তাঁর যৌবনের পরিণত মনস্কতার ফসল। তবে, এ-কথা অনস্বীকার্য যে, এর বীজ ছিল তাঁর শৈশব-কৈশোরেই। এই সূত্রেই তাঁর কৈশোরের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তখনও মৃণালের শহর ফরিদপুর। সবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এর মধ্যেই পুলিশের ভয় কাকে বলে তা মৃণাল বুঝেছেন। তবে, আরও একটা শিক্ষাও পেয়েছিলেন। সেবার প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়ার জন্য মৃণাল ও তাঁর বন্ধুদের থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের ভয়ে তখন ছোট্ট মৃণাল প্রায় কেঁদে ফেলেছে। ঠিক সেই সময়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন তাঁর বাবা। বাবাকে দেখে মৃণাল বন্ধুদের ছেড়ে বাবার কাছে চলে আসে। আর, সেই সময়ই ছেলের গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়েছিলেন মৃণালের বাবা। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, অন্যায়টা ঠিক কোথায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, গান্ধিজিকে কারারুদ্ধ করার প্রতিবাদে হরতালে সামিল হয়ে মৃণালের বাবাও রাজরোষে পড়েছিলেন।
যে-ঘটনার কথা উল্লেখিত হচ্ছে, তখন তিনি আর-একটু বড়। বয়স বছর পনেরো। জুবিলি পার্কে হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাষণ দেওয়ার কথা। জনাসমাগম দেখার বাসনায় কিশোর মৃণাল সেখানে পৌঁছেও গিয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ সুবক্তা। মানুষ তাঁর কথা শুনলও। কিন্তু যখনই তিনি বলতে শুরু করলেন যে, ‘সুভাষচন্দ্র বসু মুসলিম লিগের সঙ্গে এবং তা হিন্দুদের পক্ষে ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, তখনই জনতা হইহই করে উঠল।’ সব মিলিয়ে সেদিনের পরিস্থিতি বেশ উত্তালই হয়েছিল। এই ঘটনার কথা মনে রেখেছিলেন মৃণাল। উত্তরকালে নিজের আত্মজীবনী লিখতে বসেও কিশোরকালের এই ঘটনার স্মৃতি তিনি তুলে এনেছিলেন। এটি একটি ঘটনামাত্র। কিন্তু আত্মজীবনীর পরতে পরতে যা উঠে আসে, তা জানায়, যে, গান্ধীহত্যা থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মতো ঘটনা, দেশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক পালাবদল – সবকিছুকেই গভীর মনযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মৃণাল, আত্মস্থ করেছিলেন, সেই কৈশোর থেকেই। আর তাই পরবর্তীতে এই সময়চেতনা নাড়ির স্পন্দনের মতোই তাঁর শিল্পমাধ্যমে জেগে থাকে। তাকে আলাদা করা যায় না। আবার তাকে কোনও সময়ের কোঠায় ফেলাও যায় না।
এখানেই অমরত্ব লাভ করেন মৃণাল সেন। তাঁর দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিরন্তর আলোচনা চলতে পারে, তর্ক হতে পারে, কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে, তাঁর নির্ধারিত ফ্রেমের ভিতর দাঁড়িয়েই আজ সময়ের পুনরাবিষ্কার সম্ভবপর। সময় পেরিয়ে এসে আজও ইতিহাসের বিস্তার এভাবেই সম্ভব হচ্ছে ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে দৈন্দদিনতায়। আমরা জানি, এই দুরূহ কাজটি যিনি সম্ভব করে তুলতে পেরেছেন বা পারেন, কালের সেই রাখালই কালজয়ী হয়ে ওঠার দাবি রাখেন। যেমন, মৃণাল সেন।