ফারাক্কা ব্যারেজ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ, বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের কপালে জুটেছিল ‘পাকিস্তানের চর’ তকমা


অক্টোবরের শুরুতেই বন্যার প্রকোপে পড়েছে বিহার। ড্যামগুলি থেকে বিপুল পরিমাণে জল ছাড়া হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনই যে, বন্যার রেশ বিহার থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এর জন্য দায়ী করেছেন ফারাক্কা ব্যারেজকে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে ঠিক এই সতর্কবার্তাই দিয়ে গিয়েছিলেন একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার। যার জন্য পরবর্তীতে বিপদেও পড়েন তিনি। তাঁর কপালে জোটে ‘পাকিস্তানের গুপ্তচর’ তকমা। তিনি আর কেউ নন, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য।

১৮৫৩ সালে আর্থার কটন বলে এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের কল্পনার ফসল এই ফরাক্কা ব্যারেজ। অবশ্য তাঁর ভাবনাটির বাস্তব রূপায়ণ তখন করা হয়নি। ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পর, ১৯৪৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর্থার কটনের এই ভাবনাটিকে আবার সামনে নিয়ে আসে। পরে, কেন্দ্রীয় সরকারও তাতে সিলমোহর দেয়। ১৯৬১ সালে গঙ্গার ওপর এই ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ শুরু হয়। কপিল ভট্টাচার্য তখন রাজ্যের চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে আসীন। সেই সময় তিনি রাজ্যের সেচ মন্ত্রকের প্রকল্পগুলির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। প্রবলভাবে তিনি এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেন। তাঁর যুক্তি ছিল হুগলি নদী, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা নদীর অংশটিতে ক্রমশ পলি জমা হচ্ছে। এবং এই অত্যাধিক পলি জমার জন্য দায়ী আরও দুটো বড় ড্যাম, যেটি দামোদর এবং রূপনারায়ণের ওপর অবস্থিত। যার জন্য কলকাতা বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।

কপিল ভট্টাচার্য আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি হলে নদীর নাব্যতা আরও কমবে। ফলে এর আশেপাশের অঞ্চলগুলি একটা সময় বন্যার কবলে পড়তে পারে। তিনি এও বলেছিলেন যে, গঙ্গার স্বাভাবিক জল চলাচলে ব্যাঘাত ঘটবে এটা তৈরি হলে।
তাঁর এই কথা এবং আশঙ্কা প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন পড়ে যায়। উল্লেখ্য, কপিলবাবুর আগে আর কেউ ফারাক্কার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে কথা বলেনি। ফলে, তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একটা ঝড় ওঠে প্রায়। কপিলবাবুর বক্তব্যকে সমর্থন জানায় তখনকার পাকিস্তান (পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ) সরকার। ফলস্বরূপ, তাঁর ওপর শুরু হয় আক্রমণ। কেন্দ্রীয় জলমন্ত্রী তাঁকে সরাসরি ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করেন। সংবাদপত্রে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি নাকি পাকিস্তানের চর! এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে খানিক চেনা চেনা লাগছে না?

কপিল ভট্টাচার্যের এই অভিযোগ শেষপর্যন্ত ধোপে টেঁকেনি। ১৯৭২ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ খোলা হয়। কিন্তু কপিলবাবুর এই আশঙ্কা যে কতটা সত্যি, আজ সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ সমস্ত জায়গায় বন্যার পরিস্থিতি। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর গলাতেও শোনা গেছে কপিলবাবুর সুর। যুক্তিযুক্ত অপ্রিয় আশঙ্কার কথা বলায় একসময় যাকে পাকিস্তানের চর বলে আক্রমণ করা হয়েছিল, সেই সময় তাঁর কথা মানলে এই সমস্যা হয়ত হত না।