রেখে-ঢেকে কথা বলার মানুষ তিনি কোনোদিনই নন। ফলে, বিতর্কও তাঁর পিছু ছাড়ে না। তাঁর ছবিতেও সমকালকে নিয়ে নানা তীক্ষ্ণ ব্যাঙ্গ, রাজনৈতিক ভাষ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এবং এরই মধ্যে তিনি অনায়াসে ছবিতে বুনে দিতে পারেন তির্যক এবং অনাবিল মজা। শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতেই বলতে পারেন নিটোল গল্প। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’, ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর পাশাপাশি বানাতে পারেন ‘মেঘনাদ বধ রহস্য’-এর মতো থ্রিলারও। তাঁর সাম্প্রতিক ছবি ‘বরুণবাবুর বন্ধু’-ও কলকাতার বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহে ‘হাউজফুল’ তকমা পেয়েছে। কার কথা হচ্ছে, তা বলতে পারার জন্য কোনো পুরস্কার স্বাভাবিকভাবেই নেই। অনীক দত্তর সঙ্গে আড্ডা জমাতে আমরা হাজির হয়েছিলাম তাঁর হিন্দুস্থান পার্কের ফ্ল্যাটে। খোলামেলা আড্ডায় উঠে এল তাঁর সাম্প্রতিক সিনেমার ঘর থেকে সিনেমা তৈরির ‘বাহির’—সবটাই।
আরও পড়ুন
এই ছবি করার পর ‘পার্সেল’ এলে ভয়ও পেতে পারি: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
‘বরুণবাবুর বন্ধু’ নামটার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পের নাম মিলে যাওয়ার ব্যাপারটি যে সচেতনভাবেই ঘটানো, হাসতে হাসতে স্বীকার করে নিলেন অনীক দত্ত। “এটাকে বলে বিজ্ঞাপনের শয়তানি”। এই সিনেমায় যে নানাভাবে সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য সিনেমার রেফারেন্স উঠে আসে, সেগুলোও কি ইচ্ছাকৃত? এই যেমন, বরুণবাবুর নাতির নালিশ করতে আসার দৃশ্য যেন অনেকটাই ‘শাখা-প্রশাখার’ সেই দৃশ্যকে মনে পড়িয়ে দেয়। অনীক দত্ত বলছিলেন, এটা ইচ্ছাকৃত নয়। অনেকসময় অবচেতনেই ঘাপটি মেরে থাকে কোনো প্রভাব। সেগুলো সিনেমায় বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
আরও পড়ুন
‘রজত কাপুরকে অনেক জ্বালানোর পরেও তাঁর পেশাদারিত্ব মুগ্ধ করেছে’ – ‘শব্দ জব্দ’ টিমের সঙ্গে আড্ডা
‘বরুণবাবু’ কি তিনি নিজেই? অনীক দত্ত হাসলেন ফের। “পুরোটা আমি নই, তবে খানিকটা আমি তো আছি বটেই।” বরুণবাবুর মতো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সমর্পণ তাঁর নেই, চারিত্রিক ঋজুতাও হয়তো অতখানি নেই। তবু, বরুণবাবুর নানা স্বভাবে, পছন্দের ভিতরে পরিচালক বাসা বেঁধে আছেন। কিন্তু অনীক দত্ত মানুষটা নিজেও কি কম রাজনৈতিক? সাম্প্রতিক রাজনীতি নানা মুখোশ পরে তাঁর সিনেমায় হাজিরা দেয়, প্রমোদ প্রধান, বাচ্চাদা-র মতো ‘নেতা’ কিংবা ‘বিতর্কিত’ সংলাপ ঢুকে পড়ে। এই সিনেমাতেও বামপন্থার প্রতি বরুণবাবুর স্নেহ, সমর্পণ—এগুলো কি তাঁর রাজনৈতিক পক্ষপাতকেই স্পষ্ট করে না? তিনি কি রাজনীতির কনটেক্সটকে মাথায় রেখেই চিত্রনাট্য সাজান নাকি চিত্রনাট্যের প্রয়োজনেই রাজনীতি চলে আসে তাঁর সিনেমায়? অনীক দত্ত বলছিলেন, রাজনীতি তাঁর সিনেমায় স্বাভাবিকভাবেই আসে। জোর করে কিছু টেনে আনার জন্য তিনি লেখেন না।
আরও পড়ুন
“আমি চাই, আমার সিনেমা দর্শককে বিব্রত করুক, অস্বস্তিতে ফেলুক”— ইন্দ্রাশিস আচার্যর সঙ্গে একটি আড্ডা
কথায় কথায় উঠে আসছিল তাঁর পারিবারিক জীবন। ঘোর কংগ্রেসি পরিবার, দাদুর সঙ্গে বিধানচন্দ্র রায়ের সম্পর্ক। জরুরি অবস্থাতেও তাঁর বাড়িতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত ইন্দিরা গান্ধীর ছবি। এই পরিবেশে বড়ো হয়েও তিনি যেন অনেকটাই ‘বাম’-ঘেঁষা। বর্তমান শাসকদলের প্রতি তাঁর ক্ষোভের আড়ালে রয়েছে নানা ঘটনা। অনীক দত্ত বলছিলেন বেশ সাহসী ভঙ্গিতেই।
আরও পড়ুন
‘মনে কষ্ট নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই’
কলকাতার বাইরে কাজের অনেক প্রলোভন ছিল। কিন্তু কলকাতার একটা মেজাজ তাঁকে ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল নিজের শহরে। সেই ‘মেজাজ’-টাই হারিয়ে গেল হুট করে। এই হারিয়ে যাওয়ার আড়ালেও একটা বিশেষ রাজনীতি আছে। নিজের সিনেমায় সেই রাজনীতিকেই হয়তো তাই বারবার উন্মুক্ত করতে চান অনীক দত্ত।
এই আলাপচারিতার বিস্তারিত আঁচ পেতে দেখতেই হবে ওপরের লিঙ্কের ভিডিওটা। এটা প্রথম পর্ব। অকপট অনীক দত্তর সঙ্গে কথা জারি থাকবে। অপেক্ষায় থাকুন।