পেশায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবের গবেষক। সেইসঙ্গে বিশ্বের প্রথম সারির লজিক পাজেল বিশেষজ্ঞদের তালিকাতে অনায়াসেই চলে আসে তাঁর নাম। তবে অন্য একটি পরিচয়ও আছে তাঁর। তিনি বাঙালি গোয়েন্দা চরিত্র একেনবাবুর স্রষ্টা।
সুজন দাশগুপ্ত (Sujan Dahgupta)। বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র তিনি। সম্ভবত লজিক পাজল নিয়ে বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম তিনিই রচনা করেছিলেন সম্পূর্ণ উপন্যাস। তাছাড়াও একেনবাবু (Ekenbabu) তো রয়েছেই। কিপ্টে, গোলগাল, ন্যালা-ক্যাবলা, নিপাট ভদ্রলোক— এমন ছাপোষা গোয়েন্দা চরিত্র বাংলা তো বটেই, অন্য কোনো ভাষার সাহিত্যেও রয়েছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এবার রহস্যজনকভাবেই বিদায় নিলেন রহস্যকাহিনির স্রষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী হলেও, কয়েকমাস আগেই কলকাতায় ফিরেছিলেন তিনি। সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। বাড়িতে একাই ছিলেন সুজনবাবু। বুধবার সকালে বাড়িতে এসে বহু ডাকাডাকি করেও সাড়া পাননি তাঁর পরিচারিকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় কলকাতা পুলিশ। দরজা ভেঙে উদ্ধার হয় তাঁর মৃতদেহ। হয়তো এই মৃত্যু স্বাভাবিকই। তা সত্ত্বেও যেন গল্পের মতোই রহস্যের জাল বিছিয়ে গেলেন তিনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
“সুজনবাবু সম্পর্কে সকলেই যেটা বলবেন, তা হল এমন ডাউন টু আর্থ মানুষ দেখা যায় না। উনি প্রফেশনাল দিকে যেমন সফল, একেনবাবুর স্রষ্টা হিসাবেও তাঁকে কে না জানে। তারপরেও তাঁর যে অভিব্যক্তি, জুনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলার তাঁর যে ঢঙ, তা শিক্ষণীয়। পাণ্ডুলিপি যেটা দিতেন, সেটা বই হিসাবে সাজানোর ক্ষেত্রে ওঁর ফিডব্যাক অবশ্যই থাকত। কিন্তু সেটা কখনোই চাপিয়ে দিতে চাইতেন না।”
বলছিলেন ‘সৃষ্টিসুখ’-এর প্রকাশক রোহণ কুদ্দুস। সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুজনবাবুর একাধিক বই। এমনকি জানা গেল, চলতি বইমেলাতেও প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল আরও একটি বই। কিন্তু তার ঠিক আগেই বাংলা সাহিত্যজগৎ হারাল তার অন্যতম নক্ষত্রকে। ম্লান হয়ে গেল কলকাতা বইমেলার উন্মাদনা। রোহণ কুদ্দুসের কথায়, “মনে হল যেন কোনো নিকট আত্মীয় চলে গেলেন। আমরা যা-ই বলব সেটা বাহুল্য।”
‘দি ক্যাফে টেবিল’ প্রকাশনার কর্ণধার ও প্রকাশক অভিষেক আইচ জানালেন, “সুজনমেসো আমাদের কাছে শুধু সাহিত্যিক নয়, উনি আমাদের অভিভাবক। মা-বাবার মতোই একজন মানুষ এভাবে হঠাৎ করে চলে গেলেন, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এবছর বইমেলায় প্রকাশিত হবে একেনবাবুর ষষ্ঠ সমগ্র। আরও কিছু কাজের কথা ছিল। গত সোমবারই ওঁর সঙ্গে আমি এবং আমার কলিগরা পাঁচটা থেকে আটটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি। এটা মানা যায় না। তবে আশার কথা, বইটা ওঁকে দেখাতে পেরেছিলাম।” উল্লেখ্য, এই প্রকাশনা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে একেনবাবু সমগ্রের প্রতিটি গ্রন্থ।
সুজনবাবু তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সংবাদপত্রে চিঠির লেখার মধ্যে দিয়েই লেখালিখির জগতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। পরবর্তীতে গবেষণা সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর তিনি পরিচিত হন লজিক্যাল পাজলের সঙ্গে। সেটাই যেন নেশা হয়ে ওঠে। লজিক্যাল পাজল ঢুকে পড়ে নিজের লেখালিখির মধ্যেও। প্রথমে গল্প, তারপর উপন্যাস। আনন্দবাজারের আনন্দমেলা এবং ইত্যাদি প্রকাশনের কিশোর মন পত্রিকায় প্রকাশিতও হত সেসব গল্প-উপন্যাস।
প্রথম বই-এর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে আনন্দমেলা। ‘ধাঁধাঁপুরীর গোলকধাঁধাঁ’। এই উপন্যাসটিও তিনি পাঠিয়েছিলেন আনন্দমেলার জন্যই। সে-সময় আনন্দমেলার সম্পাদক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। এই উপন্যাসটিকে আলাদা করে বেছে রেখেছিলেন তিনি। অবশ্য সে-ব্যাপারে কিছুই জানতেন না সুজনবাবু। পত্রিকার সংখ্যায় সে-বার এই গল্প না দেখতে পেয়ে খানিক হতাশই হয়েছিলেন তিনি। তবে কলকাতায় ফেরার পরই ভেসে আসে সুসংবাদ— আনন্দ থেকে বই আকারে ‘ধাঁধাঁপুরীর গোলকধাঁধাঁ’ প্রকাশের খবর।
নীরেন্দ্রনাথের হাত রয়েছে কিংবদন্তি গোয়েন্দা চরিত্র একেনবাবুর পিছনেও। নীরেন্দ্রনাথই সুজন দাশগুপ্তের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, গোয়েন্দাকাহিনি লেখার জন্য। সেটা নব্বই-এর দশকের শুরুর দিক। কিশোরদের জন্যই প্রথম গোয়েন্দা চরিত্র একেনবাবুকে তৈরি করেন তিনি। প্রথম গল্প ‘ম্যানহাটনে মুনস্টোন’ প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দমেলায়। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমশ জনপ্রিয়তা বেড়েছে ব্যতিক্রমী এই গোয়েন্দা চরিত্রের। যিনি বন্দুক নিয়ে অপরাধীদের পিছনে ছোটেন না। অংশ নেন না সম্মুখ লড়াইতেও। বরং, ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং অ্যানালাইসিসই তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। পরবর্তীতে তরুণ প্রকাশকদের অনুরোধে বড়োদের জন্যও তিনি রচনা করেছেন একেনবাবুর একাধিক কাহিনি। পরে ‘সমগ্র’ আকারে এইসব গল্প প্রকাশ পায় ৫টি খণ্ডে। সবমিলিয়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, লজিক্যাল পাজেলিং— এমন এক বহুমুখী প্রতিভার চলে যাওয়ায়, ঔজ্জ্বল্য হারাল বাংলা। শোকস্তব্ধ আপামর একেন-প্রেমী…
Powered by Froala Editor