বারোয়ারি গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ী : রোমাঞ্চ পত্রিকার বিস্মৃত ইতিহাস

(দ্বিতীয় পর্ব)

গত শতাব্দীর তিরিশের দশক। ধর্মসংস্থাপনার্থায় কিরীটি-ব্যোমকেশ-ফেলুদার যুগ আসতে ঢের দেরি তখনও। গত-শতাব্দীর ‘গোয়েন্দা-কাহিনী’র(১৮৯৪-৯৮) কাহিনিরা নতুন সংস্করণের জোয়ারে দুহাজারের কাছাকাছি পুর্নমুদ্রণে মাঝেমধ্যে পড়ন্ত বাজার-বেলায় এসে পড়ছে। ক্রাইম-কাহিনিতে রমরমা বলতে পাঁচকড়ি দে আর দীনেন রায়ের বই-এর। আচার্য সুকুমার সেনের ভাষায়, এমন সময়েই বাংলা ক্রাইম-কাহিনির ইতিহাসের পাতা উলটে দিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। ঠিক কী করেছিলেন আসলে? ১২ নম্বর হরিতকী বাগান লেনে নিজের ছাপাখানার এক ছোট্ট ঘরে কিছু বয়স্য, কিছু অনুজ বন্ধু-সাহিত্যিককে নিয়ে পৌষের এক সকালের তাসের-আড্ডায় হঠাৎ-ই বাংলার প্রথম বারোয়ারি গোয়েন্দার পরিকল্পনাটি করে ফেলেছিলেন। মূল প্রস্তাবটি ছিল আসলে মৌলিক গোয়েন্দা-গল্পের একটি পত্রিকা তৈরির। কিন্তু পত্রিকার প্রাণভোমরা ছিল এই মৃত্যুঞ্জয়ী আইডিয়াটি— অনেকে মিলে লিখলেও, পত্রিকার কমন-গোয়েন্দা হবে একটাই। এভাবেই এল ‘রোমাঞ্চ’ আর ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকার কমন-গোয়েন্দা— প্রতুল লাহিড়ী। রাইখস্ট্যাগে আর এক বছরের মধ্যে আগুন লাগবে। আন্তর্জাতিক বাজার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ টের পাবে। সেই আঁচে পাতার দাম বাড়বে, সস্তা নিউজপ্রিন্টের চটি বই বিনোদনের পাঠ-সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়তা পাবে। তবে সেসব হতে তখনও বছর-দশ দেরি। ১৯৩২ সালে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর হাতে প্রতিষ্ঠিত হল ক্রাইম-কাহিনির সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘রোমাঞ্চ’ আর প্রতুল লাহিড়ীর যাত্রা হল শুরু। প্রতুলের কোনও একক স্রষ্টা নেই, ‘রোমাঞ্চ’ তার ধাত্রী এবং এজেন্সিও।

সাপ্তাহিক রোমাঞ্চ'র প্রচ্ছদ। (সৌ: সুজিত কুণ্ডু)

 

বাজারসফল গোয়েন্দা-'সিরিজ'-এর বর্ধমান জনপ্রিয়তার সামনে গোয়েন্দা-'পত্রিকা'রা সেকালে ছিল স্বল্পজীবি। বিশ-শতকের দ্বিতীয় দশকে নতুন কোনো গোয়েন্দা-পত্রিকার জন্ম হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে না, সেখানে এই বাজারে ‘রোমাঞ্চ’র ‘পত্রিকা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ সত্যিই পত্রিকার সম্পাদক মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের দুঃসাহসেরই পরিচয়। অবশ্য এই সাহসের উৎস ছিল তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুবৃত্ত। সম্পাদক  জানতেন লেখকগোষ্ঠীর আনুকূল্য পেতে ‘রোমাঞ্চ’র অসুবিধে হবে না, তাই 'বারোয়ারি গোয়েন্দা' প্রতুলের ধারাবাহিক গল্প প্রকাশেও আসবে না কোনও বাধা।

আরও পড়ুন
বারোয়ারি গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ী : ‘বাংলার শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ’

পীতাতঙ্ক প্রভাবিত জাতিবিদ্বেষ বিশ-শতক জুড়ে বাংলা ক্রাইম-কাহিনির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য থেকেছে। রোমাঞ্চের প্রচ্ছদ হয়ে উঠে আসা এই অলংকরণে 'চীনা দস্যু'র কুটিল অভিব্যক্তিটি লক্ষণীয়।

 

সত্যিই প্রথম সংখ্যা বিক্রির পর রোমাঞ্চকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি, বরং জানা যাচ্ছে পত্রিকার অফিসে প্রকাশিতব্য সংখ্যার হাল-হকিকত জানতে আগ্রহী স্কুলপড়ুয়া আর কাগজ-বিক্রেতার আনাগোনা বেড়েছে। প্রতি শনিবার দু’ফর্মা করে সাপ্তাহিক ‘রোমাঞ্চ’ প্রকাশ পেত যাতে বিভিন্ন লেখকের কলমে প্রতুলের গোয়েন্দাগিরির নানা গল্প বেরোত; সাধারণত একটি সংখ্যায় একটি গল্প, কখনো একাধিক সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে একটি গল্প। দাম— এক আনা, পৃষ্ঠা সংখ্যা কমবেশি বত্রিশ। সম্পাদনার দায়িত্ব ও ব্যয়ভার মৃত্যুঞ্জয়বাবুর, পরের দিকে যদিও গল্প লেখাতেও হাত দেন। উত্তর কলকাতায় হাতিবাগান, শোভাবাজারের মোড়, আর রূপবাণী সিনেমার পাশে পত্রিকাটি বিক্রি হত বলে জানা যাচ্ছে। দক্ষিণ কলকাতায় জগুবাবুর বাজারের কাছে, মধ্য কলকাতায় শেয়ালদা স্টেশন আর ধর্মতলার ফুটপাতে বইয়ের দোকানদার আর হকারদের কাছেও পত্রিকার প্রত্যেকটি সংখ্যা সময়মতো পৌঁছে যেত।

সাপ্তাহিক রোমাঞ্চ'র প্রচ্ছদ। (সৌ: সুজিত কুণ্ডু)

 

কেমন ছিল হার্ড বয়েলড গোয়েন্দার সম্ভবত প্রথম বঙ্গীয় সংস্করণ প্রতুল? জানা যাচ্ছে, সরকারি দপ্তরে গোয়েন্দা প্রতুলের খাতির মন্দ নয়। প্রতুলের বাল্যবন্ধু, ছায়াসঙ্গী বিশু তার সহকারী, থাকে প্রতুলেরই সঙ্গে। দুজনেই শারীরিকভাবে সমর্থ ও সাহসী, তবে কৌশল আর বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতায় প্রতুল স্বাভাবিকভাবেই তার সহকারীর থেকে এগিয়ে থাকবে, তবে গোয়েন্দাগিরিতে সে-ও বড় কম যায় না। প্রতুল-বিশু উভয়েরই আছে চিন্তার পরিস্থিতিতে সিগারেট খাওয়ার নেশা। বন্দুকে বিশুর হাতের নিশানা অব্যর্থ, প্রতুলের হাত এই গুণটির সাথে বেহালাতেও পারদর্শী তা কিছু গল্পে দেখা যায়। হোমসিয়ান প্রভাব বলাই যেতে পারে। তবে প্রতিটি গল্পেই বন্দুকের অপর্যাপ্ত ব্যবহার এবং ‘অপরাধ’ হিসেবে অন্তত কয়েকটি হত্যাকাণ্ড প্রতুলের গল্পগুলির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। প্রতুল ‘ফুল-টাইম’ শখের গোয়েন্দা হলেও বিশুর আছে সাংবাদিকতার চাকরি। ক্লাসিকাল হুডানিট থেকে শুরু করে অ্যাকশান থ্রিলার— এতটা জুড়ে প্রতুল-বিশুর বিচরণের ক্ষেত্র। হেমেন রায় ততদিনে ত্রিশূল-গোয়েন্দার ছক (গোয়েন্দা আর তার দুই সহকারী) বাংলা গোয়েন্দা-কাহিনিতে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। বেসরকারি গোয়েন্দা প্রতুল, সরকারি সাহায্য থেকেও যেন বঞ্চিত না হয় সেজন্য পরবর্তীতে আনন্দমোহন বলে এক পুলিশ ইন্সপেক্টরও প্রতুল-বিশুর সাথে জুড়ে যান। আনন্দমোহন এবং তাঁর পুলিশ-বিভাগ সাধারণত প্রতুলের নির্দেশ ও উপদেশমতই যাবতীয় কাজ-কর্ম করেন। গল্পে সমস্তটা জুড়ে তেমন ভূমিকা থাকুক না-থাকুক, শত্রু-অপরাধীকে ধরার সময় প্রশংসনীয় উদ্যোগে বাহিনী সমেত অকুস্থলে হাজির হন তিনি। এই চরিত্রগুলি ‘প্রতুলভার্স’-এর ধারাবাহিক চরিত্র যাদের কাহিনিতে ক্রিয়াশীলতা (functionality) থাকে, এবং বারবার বহু লেখকের হাতে মোটামুটি এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়েই ফিরে আসতে দেখা যায়।

বারোয়ারি গোয়েন্দার আমদানিতে বিভিন্ন লেখকের লেখা ধারাবাহিক টেক্সটগুলির মধ্যে ঘটনা ও চরিত্রের ধারাবাহিকতার সামঞ্জস্য করতে সমস্যা তৈরি হলেও, এতে আখেরে লাভই হয়েছিল রোমাঞ্চ’র। প্রতুলের অ্যাকশান-থ্রিলার আর ডিটেকশান স্টোরিদের কল্যাণে ‘রোমাঞ্চ’-র সার্কুলেশন যে একবছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়, তার প্রমাণ মিলছে মুদ্রণতথ্যে।

Powered by Froala Editor