পাহাড়ের ট্রি-লাইন ছাড়িয়ে আরও খানিকটা উঁচু রুক্ষ-শুষ্ক হিমালয়ের উপত্যকা। চড়াই-উৎরাই প্রাকৃতিক পরিবেশের দোসর হাড় কাঁপানো শীত। লোকবসতি তো দূরের কথা, সে পথের কোনো হদিশ নেই মানচিত্রেও। এমন কোনো জায়গায় হঠাৎ যদি অন্ধকার গুহার মধ্যে মানুষের দেখা পান? চমকে উঠবেন নিশ্চয়ই? না, মনগড়া কোনো গল্পের প্লট নয়। এ ঘটনা বাস্তবেরই। সম্প্রতি, এক বাঙালি অভিযাত্রীই হিমালয়ের অজানা গুহায় সন্ধান পেলেন ‘গুহামানব’-এর। আমাদের পরিচিত সমাজের বাইরে এক অন্য জীবনের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে হিমালয়ের দুর্গম শিখরে।
“এপ্রিলের ১৮-১৯ তারিখ নাগাদ আমি সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলাম কলকাতা থেকে। প্রথমে সিমলা পৌঁছাই। তারপর ওখান থেকেই হিমাচলের বিভিন্ন আনএক্সপোরলড পাহাড়ি অঞ্চলে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোই উদ্দেশ্য ছিল। এখন তো হিমাচলে লকডাউন চলছে, নিচে যান চলাচল বন্ধ। তাই বেশিরভাগ সময় পাহাড়ের উপরের দিকেই সময় কাটাই।”
বলছিলেন অভিযাত্রী অর্ঘ্য মণ্ডল। সাইকেলকে সঙ্গী করে একক ট্যুরে অভ্যস্থ তিনি দীর্ঘদিন। এবারেও একাই হাজির হয়েছিলেন হিমাচলপ্রদেশের দুর্গম পার্বত্য উপত্যকায়। আর সেখানেই আকস্মিকভাবে তিনি খুঁজে পান গুহাজীবনের অস্তিত্ব। কিন্তু এমন অঞ্চলে মানুষের খোঁজ পেলেন তিনি কীভাবে?
আরও পড়ুন
সাইকেলে চেপেই দুটি গিনেস রেকর্ড ভারতীয় সেনার
ফোনে উত্তর দিলেন অর্ঘ্যবাবু, “আসলে কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনে যে পাহাড়ের শিখরটা দেখতে পাওয়া যায়, সেটাকেই এক্সপ্লোর করার জন্য অভিযান শুরু করি। তো এরমই একটা পাহাড় এক্সপ্লোর করতে গিয়েছিলাম। ম্যাপে সেই অঞ্চলটা হদিশ তো নেই-ই, সেইসঙ্গে কোনো তথ্য দিতে পারেনি স্থানীয় লোকজনরাও। সাধারণ মানুষজনের আনাগোনা না থাকায়, কোনো নির্দিষ্ট রাস্তাও নেই সেখানে। ওই পাহাড়ে পৌঁছানোর সময় গভীর জঙ্গলে পথ হারাই। ফেরার পথে তখন কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কথা বলে জানতে পারি পাহাড়েই থাকেন তাঁরা। ওঁদের সঙ্গে সেই রাতটা কাটিয়ে পরদিন আবার নিচে ফেরা।”
আরও পড়ুন
আক্রান্তদের জন্য তহবিল গড়তে সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ ক্যানসার-জয়ীর
কিন্তু যেখানে পৌঁছানোর রাস্তাই নেই, সেখানে থাকার ব্যবস্থাই বা কোথায়? চমকে উঠতে হল অর্ঘ্যবাবুর কথায়। সে-রাতের মতো ছোট্ট পাহাড়ি গুহাই ছিল মাথা গোঁজার ঠাঁই। কনকনে ঠান্ডার মধ্যে পাতলা কম্বল নিয়েই সেই রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন তিনি। শুধু হিমশীতল প্রাকৃতিক পরিবেশই একমাত্র প্রতিকূলতা নয়। সেখানে রয়েছে প্রতিপদে বিপদের হাতছানি। কথায় কথায় জানা গেল, ভাল্লুকের আনাগোনা এই উপত্যকায় নিত্যদিনের ঘটনা।
আরও পড়ুন
১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাইকেল-পথের পরিকল্পনা কলকাতায়
আর সেই মানুষগুলো? তাঁদের পরিচয়? অর্ঘ্যবাবু জানালেন, “ওঁরা মূলত বেদুইন। সকলেরই বাড়ি আছে পাহাড়ের তলার দিকে। তবে জীবিকার জন্য বছরের বেশিরভাগ সময়টাই ওঁরা এভাবে গুহার মধ্যেই কাটান। ওঁদের মধ্যে বিভিন্ন যাযাবর সম্প্রদায় রয়েছে। ‘গাদ্দি’-রা পাহাড়ের উপরে মূলত ভেড়া চড়াতে যান। কিছু মানুষ জংলি জড়িবুটি সংগ্রহ করেন। কেউ আবার পাহাড়ে পাহাড়ে জেমস খুঁজে বেড়ান। হিমালয়ে এঁরা চিরকালই ছিল, আমাদের লোকচক্ষুর আড়ালে।”
একটানা কথাগুলো বলে থামলেন অর্ঘ্যবাবু। এর পর সত্যিই শিহরিত হওয়ার অবকাশ থাকে না। বিস্মিত হতে হয় বেদুইনদের এমন অদ্ভুত দৈনিক যাপনচিত্র শুনলে। পানীয় জল সংগ্রহ করতেই তাঁদের অতিক্রম করতে হয় কয়েক মাইল পথ। আবার শুকনো কাঠের সন্ধান না পেলে ঠান্ডায় জমে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনাও প্রবল। মাসে দু-একবার শুধু নিচে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহের জন্য নামা। মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বলতে সেইটুকুই। তারপর আবার এমন গহীন অরণ্যে নিভৃতবাস। কোনো বিনোদন নেই সেখানে। শুধু রুটিনে বাঁধে কঠোর জীবনের অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি করে চলা প্রতিনিয়ত। সত্যিই এ এক অসম্ভব রোমাঞ্চকর জীবন। টেলিভিশন পর্দার ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-ও হার মানতে বাধ্য হিমালয়ের এই ভূমিপুত্রদের কাছে।
তবে এই প্রথম নয়। এর আগেও এইসব বেদুইনদের সঙ্গে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে অর্ঘ্যবাবুর। কিন্তু দু-এক দিন তাঁদের সঙ্গে থেকে কতটাই বা চিনে উঠতে পারা যায় এমন অভিনব এক জীবনযাপনকে? “প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবে সম্ভব হলে একটা গোটা সিজন এমন বেদুইনদের সঙ্গে কাটাব কোনোদিন”, বলতে বলতেই স্বপ্নালু হয়ে যাচ্ছিলেন অর্ঘ্যবাবু। তাঁর এই অভিযাত্রীর জীবনকেই বা কম রোমাঞ্চকর বলা যায় কী করে?
Powered by Froala Editor