কুস্তি লড়তেন বাঘের সঙ্গে, কবর ফুঁড়ে উঠে এসেছিলেন বাংলার সুশীলা সুন্দরী

উনিশ শতকের শেষভাগ। খোদ কলকাতায় বাঘের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছেন এক রক্তমাংসের মানুষ! বিস্ময়ে হতবাক সার্কাসের দর্শকরা। আজকের দিনে হয়ত দূরকল্পনাতেও ভাবতে পারবেন না যে ঐ মানুষটি একজন মহিলা, ঊনিশ শতকের গোঁড়া সমাজে দাঁড়িয়ে এক মহিলার রূপকথা আজ অনেকাংশে বিস্মৃত। ইনি সুশীলা সুন্দরী। বাঘের সঙ্গে সার্কাসে খেলা দেখানো প্রথম ভারতীয় মহিলা!

একুশ শতকের প্রথম দশকে কিছুটা জনপ্রিয়তা থাকলেও, আস্তে আস্তে শীতের কলকাতায় যে জিনিসটা একেবারেই হারিয়ে গেল, তা হল সার্কাস। অথচ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও বাঙালি মননে সার্কাস ছিল এক অন্য আমেজ। কলকাতা ময়দানে শীতের বিকেলে জমে উঠত আসর। এই সার্কাস বাংলায় প্রথম নিয়ে আসেন নবগোপাল মিত্র। তবে এই সার্কাস ছিল মূলত দুটি ঘোড়া ও কিছু জিমন্যাস্টের নিজেদের ক্রীড়া প্রদর্শন। নবগোপাল মিত্রের জামাই রাজেন্দ্রলাল সিংহ ১৮৮৩ সালে কিছু বিদেশি খেলোয়াড়ের সাহায্যে শুরু করেন ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’৷ তা ছিল মূলত বিদেশি জিমন্যাস্টদের খেলা। ভারতবর্ষে সার্কাস উনিশ শতকের শেষে যে তিনটি অঞ্চলে - বম্বে প্রেসিডেন্সি, মুম্বই প্রেসিডেন্সি ও ত্রিভঙ্কুর বা বর্তমানে দক্ষিণের কেরালা অঞ্চল। এই তিন জায়গা থেকে জাগলিং-ট্রাপিজ খেলায় পারদর্শী ক্রীড়াবিদদের দল সারা ভারতে ঘুরে ঘুরে সার্কাসের তাঁবু ফেলত। সেই সময়ে সার্কাসে হিংস্র পশুর চল শুরু হয়নি সেভাবে।

তবে আধুনিক সার্কাস বলতে যা বোঝায় তার সূচনা ‘বোসের গ্রেট বেঙ্গল’ সার্কাসের মাধ্যমে৷ এই সার্কাস কোম্পানির মালিক ছিলেন ছোটো জাগুলিয়ার মতিলাল বসু৷ তাঁর স্ত্রী রাজবালার হাত ধরেই প্রথম বাঙালি নারীর সার্কাসের জগতে পদার্পণ৷  ট্রাপিজের খেলা দেখাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এরপর প্রিয়নাথ বসু এই গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের মালিকানা লাভ করেন।  ১৯০৯ সালে তিনি গ্রেট বেঙ্গলের নাম পাল্টে রাখেন প্রফেসর বোসেস গ্র্যা ন্ড সার্কাস। তবে বাংলার এই সার্কাস গ্রুপের ততদিনে একটি বড় প্রাপ্তি হয়ে গিয়েছিল। 

১৮৯৬ সালে রেওয়াদের মহারাজা তাঁদের কৌশলে খুশি হয়ে একজোড়া বাঘ উপহার দেন, নাম লক্ষ্মী ও নারায়ণ। এরপরেই বাংলায় প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাঘের খেলা। এই সার্কাসে এরপরেই মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠেন ব্যাঘ্রকন্যা সুশীলা সুন্দরী। 

সুশীলার জন্ম পুরনো কলকাতার রামবাগান অঞ্চলে, ১৮৭৯ সালে। দূর্ভাগ্যবশত সুশীলার মায়ের নাম আজও জানা যায়নি। খুব ছোটো থেকেই ঘোড়সওয়ারিতে আগ্রহ ছিল সুশীলার। তিনি গোঁড়া সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিখতে শুরু করেন ঘোড়া চালনা, জিমন্যাস্টিক এবং শোনা যায় কলকাতার গজিয়ে ওঠা কুস্তির আখড়াগুলিতেও বেশ যাতায়াত ছিল তাঁর। ১৯০১ সালে সুশীলা এই সার্কাসে বাঘের খেলা দেখানোর জন্য মনঃস্থির করেন এবং বাঘের ওপর কর্তৃত্বের শিক্ষালাভ শুরু করেন। লক্ষ্মী এবং নারায়ণকে নিয়েই সুশীলার বাঘের খেলার পাঠ শুরু হয়। সুশীলার আগে যে বাঘের খেলা সার্কাসে জনপ্রিয় হয়েছিল তার প্রতি ক্ষেত্রেই বাঘকে গলায় চেন পরিয়ে রাখা হত। গ্রেট ইন্ডিয়ানের বাদলচাঁদ ছিলেন সেই খেলার অন্যতম পুরোধা। কিন্তু সুশীলা এসে পাল্টে দিলেন সংজ্ঞা। তাঁর খেলা দেখানোর সময় বাঘেরা থাকত মুক্ত। তিনি সরাসরি মঞ্চের ওপর বাঘের খাঁচায় ঢুকতেন। সুশীলার ম্যাজিক শুরু হত তারপর। তিনি বাঘকে দিয়ে নিজের অঙ্গুলিহেলনে গর্জন করাতেন, দাঁড় করাতেন আবার বসিয়েও দিতেন। যেন বীণ হাতে নিয়ন্ত্রণ করছেন বশীভূত সাপকে। এই ছিল সুশীলার ক্ষমতা, ভূ-ভারতে হইচই পড়ে গেল সুশীলার এই খেলা নিয়ে। এরপর ১৯১০ সাল নাগাদ সুশীলা আরও ভয়ানক খেলা দেখানো শুরু করলেন। বাঘের সঙ্গে কুস্তি। খাঁচায় বাঘের সঙ্গে নিজের বাহুবল দেখাতেন তিনি, দর্শকরা চিৎকার করে উঠলে দুহাতে বাঘের মুখ হাঁ করে দিয়ে চোয়াল উন্মুক্ত করে দিতেন দর্শকদের সামনে। খেলার পর বাঘের গায়ে হেলান দিয়ে তিনি বসতেন, কিছুক্ষণ পর মঞ্চে এসে কুড়োতেন মুগ্ধ দর্শকদের হাততালি। এই খেলা বারেবারে দেখানো হত গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস বা গ্র্যােন্ড সার্কাসে। সুশীলার জনপ্রিয়তা নিয়ে লেখা শুরু হল পত্রপত্রিকায়। 

সুশীলার জীবনে আরেকটি ঘটনা প্রমাণ করে দেয়, কত ভয়াবহ বাহুবল তিনি আয়ত্ত করেছিলেন নিজের দ’হাতে। জানা যায় একবার সার্কাসে শো চলাকালীন সুশীলাকে কবর দেবার পর হঠাৎ ঝড় ও মুষলধারে বৃষ্টি নামে৷ সার্কাসের শো বন্ধ করে দিতে হয়৷ বাড়ি ফিরে প্রফেসর বোসের মনে পড়ে, সুশীলাকে কবর থেকে তোলা হয়নি৷ তিনি দ্রুত ফিরে যান মাঠে৷ দেখেন সেই কবর থেকে সুশীলা গায়ের জোরে উঠে এসেছেন মাটি ফুঁড়ে। এই ছিলেন বাংলার ব্যাঘ্রকন্যা সুশীলা, যাকে আজ আর প্রায় মনেই রাখেনি সিংহভাগ বাঙালি...

সুশীলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঘদের নিয়ে যেমন খেলা দেখাতেন, তেমনই হিংস্র ও বুনো বাঘদের নিয়ে খেলা দেখানোর কৌশলও রপ্ত করেছিলেন শেষ দিকে। এই সময় থেকেই তিনি বেশ কয়েকবার বাঘের থাবায় আক্রান্ত হন কিন্তু হাল ছাড়েননি। তবে একবার সার্কাস শো-তে এক ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘের গায়ে হেলান দেবার সময় তাঁর থাবায় ভয়াবহ জখম হন সুশীলা। তারপর আর তার রিং-এ ফেরা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সুশীলার জনল্রিয়তা সে সময়ে যে কী মারাত্মক ছিল, তার প্রমাণ ইংলিশম্যান পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে একটি লেখা থেকে পাওয়া যায়। লেখাটির বাংলা তর্জমা দিলাম-

" হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের দুর্নাম যে তাঁহারা বড় ভীরু, কিন্তু এই সুশীলাসুন্দরী একগাছি ছডি় পর্যন্ত না লইয়া, নির্ভয়ে ব্যাঘ্র-বিবরে প্রবেশপূর্ব্বক দুইটি বাঘের সহিত খেলায় এরূপ অমিত সাহসের পরিচয় দেন, যে তাহা দেখিলে সত্যই চমকিত হইতে হয়৷"

১৯২৪ সালে সুশীলা চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। তাঁর জীবনে যেমন খ্যাতি আর অসীম সাহস তাঁকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল, বাঙালি মহিলার চিরাচরিত সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিল ঐ সময়ে, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে বারেবারে তাঁর জন্মপরিচয়ের অস্বচ্ছ্বতা এবং নানা সম্পর্কের সমীকরণে তাঁকে সমালোচনায় জেরবার করেছিল তৎকালীন সমাজ। তবু আজ থেকে ১২০ বছর আগে, এক বাঙালি নারী যে অসীম সাহস দেখিয়েছিলেন সার্কাসের মঞ্চে, তার তুলনা সেদিন থেকে আজ অবধি তিনি নিজেই, এক এবং অদ্বিতীয়া সুশীলা সুন্দরী!

Powered by Froala Editor