‘...এক ধরনের অঙ্গাণু আছে যা প্রতি কোষে অবশ্যই থাকবে, তার নাম ‘মাইটোকনড্রিয়া’। ...কোষের ভিতরের এই অঙ্গাণু মাইটোকনড্রিয়া আমরা পেয়ে থাকি মায়ের কাছ থেকে। প্রাকৃতিক নিয়মে একমাত্র মা-ই পারে একে দিতে, যা আমাদের দেহে শক্তির জোগানদার। এখানে বাবার কোনও ভূমিকা নেই। এই হল আধুনিক বিজ্ঞানের কথা। প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা কবে কীভাবে এই সত্যকে অনুধাবন করেছিলেন (নাকি করেননি?) তা আমাদের একান্তই অগোচর – রহস্যাবৃত।’
নিজের শেষতম বই ‘মাতৃকাশক্তি’-র উপসংহারে মাতৃশক্তির বৈজ্ঞানিক সারমর্ম এভাবেই বুঝিয়েছিলেন তিনি। তিনি, অর্থাৎ অশোক রায়। বাংলা ভাষায় শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সঠিক সমন্বয়ে এমন প্রাঞ্জল সাহিত্য সৃষ্টি যে অল্পসংখ্যক মানুষ করতে পেরেছেন, অশোক রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। উপরি-উল্লিখিত অংশেই তা বেশ স্পষ্ট। পেশায় ছিলেন ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের (Geological Survey of India, GSI) রসায়নবিদ। ফলে, শাস্ত্র, বিজ্ঞানের সঙ্গে কখনও আবার যুক্ত হয়েছে ভ্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। পাহাড়ের ঢাল ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি প্রকৃতির খেয়ালখুশির রূপে মুগ্ধ হচ্ছেন, পরক্ষণেই হয়তো সেই ভ্রমণপথের মাঝে বিশ্রামরত তিনি বিশ্লেষণ করছেন বিজ্ঞানের আঙ্গিকে, আবার কখনও মেলে ধরছেন পৌরাণিক গল্পের ভাণ্ডার।
তাঁর প্রথম বই ‘শালগ্রাম শিলার সন্ধানে’-র কথাই ধরা যাক। বইটির তিনটির পর্ব ছিল যথাক্রমে ভ্রমণ, বিজ্ঞান ও শাস্ত্র। সপরিবারে মুক্তিনাথ যাওয়ার প্রস্তুতি, নেপালে পাশ্চাত্য-লোলুপতার কদর্য রূপ, নানাপ্রকার বাধাবিঘ্ন, আবার একই সঙ্গে নানাবিধ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, হিমালয়ের অবিকৃত সৌন্দর্য – মধ্যবিত্ত ভ্রমণের সমস্তটাই উঠে এসেছিল তাঁর লেখায়। কিন্তু সেখানে একেবারের জন্যেও নিজের গবেষক-সত্তাকে বিসর্জন দেননি তিনি। মুক্তিনাথের পথে পাঠককে যখন তিনি নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর লিখন-কল্পনার গুণে, তখনই পাঠককে দেখিয়ে দিচ্ছেন বিস্তৃত মানচিত্র। আবার শালগ্রাম বা নারায়ণ শিলার সঙ্গে কালীগণ্ডক বা গণ্ডকী নদীর সহাবস্থানের পৌরাণিক কিংবদন্তি শোনাচ্ছেন দুই কিশোর-কিশোরীকে, সঙ্গে পাঠককেও। বিজ্ঞান পর্বে মূলত ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। জিওলজিক টাইম স্কেল বা ভূতাত্ত্বিক সময় বিভাগকে তিনি মিলিয়েছেন শাস্ত্রীয় কাল বিভাগের সঙ্গে। আবার শঙ্করাচার্যের ‘দশাবতার দর্শন’ যে ডারউইনের বিবর্তনবাদেরই আদি ভারতীয় রূপ, এবং দুই মতবাদে আদৌ কোনো অবস্থানগত বিভেদ নেই, সেকথাও সঠিক বিশ্লেষণে বুঝিয়ে দিচ্ছেন লেখক। প্যালেন্টোলজি অর্থাৎ পুরাজীববিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে শালগ্রাম শিলার শ্রেণীবিভাগ করেছেন শাস্ত্র পর্বে, সেখানে দেখিয়েছেন অভেদতত্ত্ব, একান্নশিলার ব্যাখ্যা। পরিশেষে এক্স-রে ফ্র্যাকশানেশন পরীক্ষার ফলাফলের সাহায্য নিয়ে শিলার রসায়নের রহস্যভেদ তাঁকে প্রকৃত অর্থেই করে তুলেছে সার্থক বিজ্ঞানসাধক।
প্রথম বই তাঁকে দিয়েছিল বিপুল জনপ্রিয়তা। এই বইয়ের জন্য ২০০১ সালে আশুতোষ মুখার্জি মেমোরিয়াল কমিটি তাঁকে উমাপ্রসাদ স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত করে। স্যার আশুতোষের তৃতীয় পুত্র, হিমালয়-পরিব্রাজক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর একান্ত আপন উমাদাদু। হিমালয়ের প্রতি তাঁর টান জন্মেছিল উমাপ্রসাদের লেখা পড়েই। তাই প্রথম বইটিও ছিল তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। কিন্তু তিনি নিজে যখন হিমালয়ের কথা লিখছেন, তখন পরিপূর্ণ নিজস্বতায় হিমালয়ের যে বিশালত্ব ধরা পড়ছে তাঁর বর্ণনায়, তা একেবারেই স্বতন্ত্র। ভ্রমণ-শাস্ত্র-বিজ্ঞানের অসাধারণ সংমিশ্রণ তিনি ঘটিয়েছিলেন তাঁর দ্বিতীয় বই ‘বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ’-তেও। সেখানে অমরকণ্টক ভ্রমণ-বিবরণের সঙ্গে মানবসমাজের বিবর্তনের আলোকে মহাকাল শিবের নানা রূপের সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত মানুষটি।
শালগ্রাম শিলা নিয়ে তাঁর আরও একটি গবেষণালব্ধ বই ‘ভগবান বিষ্ণু ও শালগ্রাম শিলা’। সেখানে সম্পূর্ণরূপেই বৈজ্ঞানিক ও শাস্ত্রীয় গবেষণার উপর লেখা সাজিয়েছেন তিনি। বিবর্তনের ইতিহাসে শালগ্রাম শিলার প্রভূত গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন – ‘এই যদি তোমার সৃষ্টি-অভীপ্সা হয়, তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে শালগ্রাম শিলা তো সত্যিই এক দিশারীয় দিশা। কাকচক্ষু পল্বলের জলে যেমন সমগ্র আকাশটাই ধরা দেয়। তেমনই শালগ্রাম শিলাও যেন মহাকালের এক চাবিকাঠি। সূর্যদেব যেমন আমাদের পার্থিব অস্তিত্বের জাজ্বল্যমান সাক্ষর। তেমনই শালগ্রাম শিলাও এক দার্শনিকতার দিশা – যেন মহাকালের রথের ঘোড়া।’
ন্যায়শাস্ত্র ও বৈশেষিক দর্শনের বিদগ্ধ পণ্ডিত অনন্তলাল ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর শাস্ত্রীয় আলোচনা হয়েছে। অনন্তলালই তাঁকে শিবলিঙ্গের বিষয়ে কাজ করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ‘সায়েন্টিফিক ইন্ডোলজি’-র নানা শাখা নিয়ে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন অশোকবাবু। সরস্বতী নদী নিয়েও বিস্তারিত কাজ করেছিলেন তিনি। পুরাণ-গবেষণা সংস্থা থেকে পেয়েছিলেন ‘পৌরাণিকী সম্মান’। ২০১৫ সালে পান ‘অ্যাস্ট্রো অ্যাওয়ার্ড’। শখ ছিল ফোটোগ্রাফিতেও। ফোটোগ্রাফিক অ্যাসোসিয়েশন অফ দমদমে ফোটোগ্রাফি শিখেছিলেন, পরবর্তীকালে গেস্ট লেকচারার হিসেবেও পড়িয়েছেন সেখানে। পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁর তোলা এক কাশ্মীরি কিশোরীর আলোকচিত্র জাপানের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রের সম্মান পায়।
এডিনবারা, বার্কলে-সহ বিদেশের চারটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে স্থান পেয়েছে তাঁর বই। সেসব কথা বলতে গিয়ে চোখটা যেন অজান্তেই চকচক করে ওঠে অশোকবাবুর স্ত্রী রাণুদেবীর। হরি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়িটা হঠাৎই যেন বড় ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে গৃহকর্তার আকস্মিক প্রয়াণে। গতবছর ডিসেম্বরেই চলে যান অশোকবাবু। একমাসও হয়নি এখনও। উত্তর কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন সাবেকিয়ানার ছোঁয়া বাড়ির প্রতিটি কোণে। তাঁর বই, ছবি, স্মারক – এসবের মধ্যেই যেন ভীষণভাবে থেকে গেছেন তিনি। কিন্তু সেসব সাজিয়ে রেখে শোভাবর্ধন করার কোনোরকম ইচ্ছা নেই রাণুদেবীর। যাঁর প্রতিটি কাজের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি, সেই মানুষটাই যে নেই। ‘শালগ্রাম শিলার সন্ধানে’-র ভ্রমণ পর্বটা রাণুদেবীকেই লিখতে বলেছিলেন অশোকবাবু। তাঁর সংশয় ছিল, স্মৃতির উপর ভর করে ভাল লিখতে পারবেন কিনা। কিন্তু স্ত্রীর উৎসাহ ও অভয় দানে সেটা অবশেষে নিজেই লেখেন তিনি। এমনই নানা গল্প ছড়িয়ে আছে ৩৭/১ হরি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়ির আনাচে-কানাচে।
ভরা মন নিয়ে ফিরছি শীতের সন্ধের ঝিমিয়ে পড়া উত্তর কলকাতার রাস্তা ধরে। কানে বাজছে রাণুদেবীর একটি কথা – ‘চারিদিকে যা অবস্থা, উনি চলে গেছেন ওনার জন্য যে শোক করব, তাও পারছি না মনে হচ্ছে। কত লোকের যে চাকরি চলে যাচ্ছে, কত আত্মহত্যা করছে, সেসবের কোনো হিসেব নেই। ভেতরের খবর কিছুই আসছে না।’ মনে হল, ‘মাতৃকাশক্তি’-কে এইমাত্র দেখে এলাম আমি। আমার আসা সার্থক।
(ছবি সৌজন্য - অর্ণব সিংহরায়)