কালীপুজো এলেই একটা সময় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বেজে উঠত শ্যামাসঙ্গীত। পান্নালাল, ধনঞ্জয় মনে করিয়ে দিতেন বাংলার শাক্তসাধনার কথা। মনে করিয়ে দিতেন দু-তিন শতাব্দী আগের রচিত রামপ্রসাদ কিংবা কমলাকান্তের লেখা পদগুলির কথা। আর তারপর মাঝের একবছরের জন্য আবার হারিয়ে যেত সেসব গান। সুরের আবহে মোড়া ইতিহাসের দলিল। অধিকাংশক্ষেত্রে আজ পাল্টে গেছে সেই ছবিটুকুও। শ্যামাসঙ্গীতের থেকে মুখ ফিরিয়েছে এখনকার প্রজন্ম। কিন্তু কীভাবে তাকে ফেরানো যায় তার শিকড়ের দিকে? সমাধান খুঁজতেই বছর তিনেক আগে অভিনব প্রয়াস নিয়েছিল বাংলা ব্যান্ড ‘প্রোজেক্ট মায়া’। রক মিউজিকের আবহেই ফুটিয়ে তুলেছিল শাক্ত চিন্তা-ভাবনাকে।
বর্তমানে ব্যান্ডে রয়েছেন ৬ সদস্য। বেসে প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী (পম), কণ্ঠে রাজর্ষি বর্মন (ডোডো), কিই-বোর্ডে সৌভিক গুপ্ত (স্যাভি), ইন্ডিয়ান পার্কাসানে সজীব সরকার, ড্রামে অভিরূপ দাস (বান্টি) ও শুভম মৈত্র।
“আমরা দেখছিলাম, আধুনিকতার ধাঁচে রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনের গান, বিভিন্ন বাউলগান নিয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু একেবারেই ব্রাত্য রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত। কিন্তু দেখতে গেলে রামপ্রসাদ সেন কিংবা কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা এই গানগুলিই বাংলা আধুনিক সঙ্গীতের জনক। এই গানগুলোই আসলে আমাদের রুট। যেখান থেকে আধুনিকতার শুরু, সেই গানগুলোই হারিয়ে যাবে? বর্তমান প্রজন্ম যাতে সেইগুলো শোনে সেই উদ্দেশ্যেই শুরু হয়েছিল প্রোজেক্ট মায়া”, বলছিলেন প্রোজেক্ট মায়ার ভোকালিস্ট রাজর্ষি বর্মণ।
তবে সার্বিকভাবে দেখতে গেলে বর্তমান তরুণরা বেশিরভাগই ঝুঁকছেন রক সঙ্গীতের দিকে। নিজের শিকড়কে চেনাতে তাই সেই পথটাই বেছে নিয়েছিলেন প্রোজেক্ট মায়ার সদস্যরা। আধুনিকতার মোড়কে উপস্থাপন করেছিলেন আধ্যাত্মিকতাকে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই রক মিউজিকের মোড়কে কি ঢেকে যাচ্ছে রামপ্রসাধের সেই চিন্তাভাবনাগুলিই? তা যে একাবারেই নয়, বললেন ব্যান্ডের বেসিস্ট প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী, “অর্থডক্সভাবে না ভেবে এটা ভাবতে হবে হারমোনিয়াম, তবলার পাশাপাশি কেন গিটার বা ড্রামস থাকতে পারে না? কারণ এখনকার ছেলেমেয়েরা সেটাকেই সবথেকে বেশি আইডেনটিফাই করতে পারে, রিলেট করতে পারে। তবে গানগুলোর সুর, ভাব, অর্থ পুরোটাই একেবারে অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করেছি আমরা। গানের বক্তব্যটা অ্যারেঞ্জমেন্টের মাধ্যমে যাতে নষ্ট না হয়, সেটাই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”
কিন্তু তারপরেও কি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি এই অভিনব উদ্যোগকে? বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন শ্রোতাদের একাংশই। তবে মোট শ্রোতাদের তুলনায় তার সংখ্যা ছিল নগণ্যই। পার্কাসনিস্ট সজীব সরকারের কথায়, “৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশই কিন্তু ইতিবাচক মন্তব্য পেয়েছি আমরা। বাকিদের অনেকেই বলেছেন এ আর নতুন কী, প্রচলিত একটা গানকেই তো এরা কভার করছে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল এই গানগুলোকে সামনে আনার। এবং সেই জায়গাটায় আমরা সফল কিছুটা হলেও। অনেকেই সাড়া দিয়েছেন আমাদের এই উদ্যোগে। নতুন করে শুনছেন শ্যামাসঙ্গীত।”
আরও পড়ুন
দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় চাউমিন, কলকাতার বুকেই রয়েছে এই চিনা কালীমন্দির
হ্যাঁ, এই এগিয়ে যাওয়ার, ইন্টারনেটের যুগে দাঁড়িয়েও ফিরেছে সেই গানগুলির জনপ্রিয়তা। রামপ্রসাদ কিংবা কমলাকান্তকে সাদরে গ্রহণ করেছেন তরুণরা। ধীরে ধীরে সিডি কেনার প্রচলন উঠে যাওয়ার সময়ে দাঁড়িয়েও মর্যাদা পেয়েছিল প্রোজেক্ট মায়া। আর ইউটিউবের মতো ডিজিটাল মাধ্যমের কথা নয়ই বাদই দেওয়া গেল।
২০১৬ সালে আধ্যাত্মিক গান নিয়েই প্রকাশিত হয় একটি অ্যালবাম। প্রোজেক্ট মায়া ব্যান্ডের নামেই প্রকাশ পেয়েছিল সেটি। ছিল ৬টি গান। যার মধ্যে অধিকাংশই শ্যামাসঙ্গীত। তবে ২০১৬ সালে আত্মপ্রকাশ করলেও শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে এই রিসার্চ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। আড্ডায় গিটার কিংবা ড্রামসের সঙ্গেই সেই আধ্যাত্মিকতার শিকড় ধরে হাঁটতেন রাজর্ষিবাবু কিংবা অভিরূপবাবুরা।
এই প্রয়াস ঠিক কতটা নাড়িয়ে দিয়েছিল তরুণ প্রজন্মকে, বাংলার মিউজিক্যাল সার্কিটকে তা বোঝা যায় ২০১৬-র পরবর্তী সময়টা দেখলেই। প্রোজেক্ট মায়ার পরেই বহু বহু বাংলা ব্যান্ডের গানের বিষয় হয়ে উঠে এসেছে শ্যামাসঙ্গীত। সেটাও তো আসলে শুরু সেই উদ্যোগেরই সাফল্য। এমনকি অনেকে প্রোজেক্ট মায়ার করা গানও হুবহু একইভাবে গেয়েছেন। অনেকটা একইরকম আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন নিজেদের ভার্সান। সেক্ষেত্রে কোথাও কি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এই মাদার-প্রোজেক্টের অভিনবত্বটাই?
আরও পড়ুন
সত্তরের দশক ও কলকাতার রক ব্যান্ড ‘শিবা’ – ম্যানেজমেন্টের জন্য নোবেল পেতেন পিসি মুখার্জি?
“সত্যি বলতে কী, আমরা ব্যবসায়িকভাবে প্রচুর লাভ করব এই চিন্তা থেকে শুরুই করিনি কখনো। চেয়েছিলাম যাতে গানগুলো পৌঁছায় সবার কাছে। কেউ যদি এভাবেই এই গানগুলো করে তাতে আপত্তি কোথায়? অনেক বিখ্যাত ব্যান্ডও হেঁটেছে এই পথে। সেক্ষেত্রে যদি গানের ভাবটা তাঁরা বজায় রাখেন, তাহলে আমাদের আপত্তির কিছুই নেই। কে আমাদের থেকে আইডিয়া নিয়ে বিখ্যাত হয়ে গেলে, সেটাও আমরা আর ভাবি না”, বলছিলেন কিই-বোর্ডিস্ট সৌভিক গুপ্ত (স্যাভি)। তবে উত্তরের অনেক ব্যান্ড ট্রিবিউটও জানিয়েছে তাঁদের। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেসবের ধার ধারা হয়নি বিন্দুমাত্র।
এখন বিষয় হল, যদি শ্যামাসঙ্গীতকেই যদি শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সত্যিই কি তা নিয়ে রিসার্চ করা হচ্ছে? তুলে আনা হচ্ছে নতুন গান? অন্যের হাত ধরে জনপ্রিয়তা পাওয়া গানকেই আর্থিকলাভের জন্য আবার তৈরি করা হচ্ছে নতুন করে। সেটাই যেন শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে চোখের আড়ালে সম্পৃক্ততার দিকেই হাঁটছে মানুষকে তাঁর অতীত চেনানোর এই প্রয়াস।
আরও পড়ুন
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামকরণ তাঁরই, প্রয়াত ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য রঞ্জন ঘোষাল
তবে নিজেদের লক্ষ্য এখনও স্থির রেখেছেন প্রোজেক্ট মায়ার সদস্যরা। চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের কাজ, গবেষণার ক্ষেত্র, তুলে আনছেন হারিয়ে যাওয়া শাক্ত পদগুলিকে। তা নিয়েই সম্প্রতি প্রকাশিত হতে চলেছে আরও একটি অ্যালবাম, জানালেন ড্রামার অভিজিৎ দাস। “আমাদের নতুন একটা সিঙ্গেল নিয়ে কাজ চলছে। সেই গানের ভিডিওতেও একটা চমকের ব্যাপার আছে। সেটা নয় সাসপেন্স থাকুক, আগে থেকে বলছি না। সবার থেকেই ফেসবুকে ই-মেল আইডি নিচ্ছি। আমরা চাই সকলেই অংশ নিক ভিডিওটাতে। এটা আমাদের থার্ড সিঙ্গেল হবে। তারপর ছ’-সাতটা গান নিয়ে পুরো অ্যালবামটা কম্পাইলের কথা ভাবব আমরা। আশা করা যায় সামনে বছরেই শুনতে পাওয়া যাবে সেই অ্যালবাম।”
প্রোজেক্ট মায়া বর্তমান প্রজন্মকে যে প্রভাবিত করেছে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে এসেও গুটিকতক গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সেই প্রভাব। শ্যামাসঙ্গীতের দ্বিতীয় অ্যালবামটির পর আরও খানিকটা বাড়বে সেই পরিধি। কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? বাংলার আদি সংস্কৃতি শাক্তসাহিত্য অনেকটা সমুদ্রের মতোই। সেই সমুদ্রের অনাবিষ্কৃত জায়গাগুলোও কবে নিজে থেকে খুঁজে দেখবে শ্রোতারা, এখন সেই অপেক্ষাই শুধু...
Powered by Froala Editor