বাংলা এবং রক, এই দুটো শব্দকে পাশাপাশি বসাতে ভুরু কুঁচকে যেত অনেকেরই। মাত্র দুই দশক আগেই এক বিখ্যাত গায়ক মন্তব্য করেছিলেন, জাপানি টপ্পা বা তিব্বতী ঠুংরির মতোই বাংলা রক এক অবাস্তব বস্তু। তবে সেই ‘অবাস্তব বস্ত’টিই আজ পৌঁছে গিয়েছে আন্তর্জাতিক সীমানায়। আর সেই পথ ধরেই কলকাতার বুকে এসে পৌঁছলো ‘গ্রাসরুট গ্র্যামি’ পুরস্কার। যে পুরস্কারকে সঙ্গীত জগতের অস্কার বলেও মনে করা হয়। এ. আর. রহমানের পর আবারও সেই পুরস্কার এল ভারতে। প্রাপক কলকাতার বাংলা রক মিউজিকের অন্যতম পথিকৃত ব্যান্ড ‘ক্রসউইন্ডজ’।
পথচলা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯০ সালে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের কিছু গান-পাগল ছাত্রছাত্রী গড়ে তুলেছিল নিজস্ব একটি ব্যান্ড। স্বাভাবিকভাবেই তখন সকলে হাসিঠাট্টা করেছিলেন। ব্যান্ডের কর্ণধার এবং বর্তমানে একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিক্রমজিৎ ব্যানার্জি বলছিলেন, “আমাদের সামনে তো কোনো সফল বাংলা ব্যান্ডের উদাহরণ ছিল না। রক মিউজিককে জীবিকা হিসাবে ভাবা যায়, এমনটা তখন কেউ কল্পনাই করতে পারতেন না। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। বছরে হয়তো চার-পাঁচটা অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত। সেই সুযোগটুকুর জন্যই মুখিয়ে থাকতাম।” প্রথম রেকর্ডিং প্রকাশ পেল ১৯৯৪ সালে। তবে সেই রেকর্ডিং-এ সবকটি গান ছিল ইংরেজি ভাষার। এরপর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় শুরু হল বাংলা রক মিউজিক তৈরি। ততদিনে দলে যোগ দিয়েছেন চন্দ্রানী ব্যানার্জিও।
১৯৯৬ সালে প্রকাশ পেল প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম ‘পথ গেছে বেঁকে’। তারপর বাকিটা ইতিহাস। বিক্রমজিৎ ব্যানার্জির গিটারের সুরে যখন শ্রোতারা একটু একটু করে ডুবে যেতে শুরু করেছেন, তখনই দরাজ গলায় চন্দ্রাণী ব্যানার্জি গেয়ে উঠেছেন ‘ঝিকো ঝিকো’ বা ‘ধোঁয়া’। রক মিউজিকের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে বাংলা লোকগান থেকে কান্ট্রি মিউজিকের ধারা। বিক্রমজিৎ ব্যানার্জির কথায়, “নানা ধরণের গান আমরা শুনতাম। অনুশীলন করতাম। আর তারপর দেখলাম নিজেদের তৈরি সুরেও সেসবের প্রভাব পড়তে শুরু করল। সেই যে নতুন সাউন্ড আমরা তৈরি করলাম, তারই নাম দিয়েছিল ওয়ার্ল্ড রক।”
বাংলার শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছেন আগেই। বছর তিনেক আগে ‘গ্রাসরুট গ্র্যামি’ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়া ছিল সেই সুরকে সারা পৃথিবীর কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা পথ। আর ২০২০ সালে পুরস্কার প্রাপকের তালিকায় দুটি বিভাগে উঠে এল এই বাংলা ব্যান্ডের নাম। একদিকে বেস্ট এশিয়ান অ্যালবাম হিসাবে পুরস্কার পেল ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘ফিরে দেখা’ অ্যালবামটি। সারা মহাদেশ থেকে ১৭৭০০টি অ্যালবামের মধ্যে ৪২০০ জন বিচারকের মতামত অনুযায়ী স্বীকৃতি পেল ‘ক্রসউইন্ডজ’। আর অন্যদিকে ‘বেস্ট ইন্টারন্যাশানাল গ্রুপ’ হিসাবেও পুরস্কৃত হল সেই বাংলা ব্যান্ড। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবছর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হল অনলাইনেই। ২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার গ্রহণ করলেন ব্যান্ডের সদস্যরা। বাংলা রক মিউজিককে এখন আর অশ্রদ্ধা করেন না কেউই। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো ব্যান্ড গড়ে তুলছে। ‘ক্রসউইন্ডজ’-এর এই সাফল্য তাদের অনুপ্রাণিত করবে বলেই মনে করছেন বিক্রমজিৎ ব্যানার্জি। তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর একটাই উপদেশ, “আরও বেশি করে গান শোনো। সবধরণের গান শোনো। চর্চা বাড়ালেই সুর আরও সাবলীল হয়ে উঠবে।”চ
Powered by Froala Editor