উনবিংশ শতক। একটু একটু করে নবজাগরণ দেখছে বাংলা। সমাজে হোক বা সাহিত্যে— সব জায়গায় আধুনিকতার হাওয়া আসতে শুরু করেছিল। আর সেই ঢেউয়েরই অংশ হয়ে হাজির হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। কিন্তু… হ্যাঁ, এখানেও ‘কিন্তু’। ধীরে ধীরে সমাজে বদল এলেও বাঙালি নারীদের স্বাধীনতার দিকে খেয়াল ছিল না সংখ্যাগরিষ্ঠের। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলেও মেয়েদের জীবন ছিল খাঁচায় বন্দি পাখিটির মতো। এমন অবস্থাতেই বিলেত থেকে ফিরে আসলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় সন্তান, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ততদিনে ইতিহাসও তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। বিলেতে গিয়ে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পাশ করে ফিরে এসেছেন সত্যেন্দ্রনাথ।
তবে কেবল এই একটি দিকেই ইতিহাস তৈরি করলেন না তিনি। ইংল্যান্ডে থাকার সময়ই কাছ থেকে দেখেছেন সেখানকার সমাজজীবন। বিশেষ করে মুগ্ধ হয়েছেন সেখানকার মেয়েদের দেখে। কি সপ্রতিভ তাঁরা, কত আধুনিক! পুরুষদের পাশাপাশি তাঁরাও এগিয়ে এসেছেন নানা কাজে। ওঁরা পারলে আমাদের বাঙালি মেয়েরাও পারবে না কেন? সিভিল সার্ভিস পাশ করার আগেই সত্যেন্দ্রনাথের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। পাত্রী যশোরের জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। নেহাতই শিশু তিনি; আচ্ছা, তাঁর হাত ধরেই যদি নতুন হাওয়া আসে? বাঙালি মেয়েদেরও তো একজন পথিকৃৎ দরকার!
মনে রাখতে হবে, সময়টা উনবিংশ শতক। সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠলেও, এইসব কুসংস্কারের সমর্থকরা ছিলেন সংখ্যায় বেশি। আর ঠাকুরবাড়ির হাত ধরে বৈভব, ধর্মসংস্কার, সাহিত্যের নতুন ধারা দেখলেও, মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারেও দেবেন্দ্রনাথও খানিক প্রাচীনপন্থী। মেয়েদের মহলে বাইরের কোনো পুরুষই যেতে পারতেন না। এক কাপড়ে থাকতেন তাঁরা। বন্ধ জানলার ওপার থেকেই চলত বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংলাপ। বিলেত থেকে ফিরে সবার আগে এই পুরো ব্যবস্থাকেই ভাঙতে চাইলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমে বাড়ি, তারপর গোটা বাংলা। বাঙালি মেয়েরাও জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে, এমনই স্বপ্ন তাঁর…
অবশ্য বিলেতযাত্রার আগেও এই আগল ভাঙার কাজ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে তাঁর। সাত বছরের জ্ঞানদানন্দিনী দেবী পা রেখেছেন ঠাকুরবাড়িতে। এমন সময় প্রিয় বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথের কাছে এক আবদার নিয়ে হাজির হলেন মনমোহন ঘোষ। বন্ধু বিয়ে করেছেন, তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী’র সঙ্গে একটু আলাপ করা যায় না! সত্যেন্দ্রনাথ আর মনমোহন দুজনের ভাবনা, আদর্শও ছিল প্রায় একইরকম। নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে দুজনের চিন্তাই সমান। এদিকে অন্যান্য বাঙালি রক্ষণশীল বাড়ির মতো ঠাকুরবাড়িতেও নানা রকম নিয়ম। মেয়েদের এমনটা করতে নেই, তেমনটা করতে নেই…। সত্যেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, এসব ভাঙতে হবেই। দরকারে ‘বাবামশাই’ দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে গিয়েও ভাঙতে হবে।
তখন গভীর রাত। বন্ধু মনমোহনকে নিয়ে লুকিয়ে অন্দরমহলে ঢুকলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সোজা চলে গেলেন নিজের ঘরে। আর তারপর? বিছানায় জ্ঞানদানন্দিনীর পাশেই বসিয়ে দিলেন মনমোহনকে! তারপর নিজে চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। জ্ঞানদা আর মনমোহন— দুজনেই কী করবেন ভাবতে পারলেন না। বেশ কিছুক্ষণ পর ঠিক যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই বন্ধুকে সদর দরজা পার করিয়ে দিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ভাগ্যিস ঠাকুরবাড়ির কেউ জানতেও পারেনি এমন কাণ্ড!
তবে এর পরে সত্যেন্দ্রনাথ যা যা করেছেন, সবই জেনেছে জোড়াসাঁকো। জেনেছে গোটা বাংলা। আইসিএস পাশ করার পর তাঁর দায়িত্ব পড়ল বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, জ্ঞানদানন্দিনীকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন। বড়োসড়ো বাজ পড়ল ঠাকুরবাড়িতে। কেবল এখানেই নয়, গোটা বাংলায়? বাঙালি মেয়ে, তার ওপর বনেদি বাড়ির বউ— তিনি কিনা জাহাজে উঠে, সবাইকে মুখ দেখাতে দেখাতে বোম্বে যাবেন! অভিভাবকদের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের তর্কযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এদিকে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা তো এক কাপড়ে থাকে। ব্লাউজ পরার চল তো তখনও ছিল না। এবারও এগিয়ে এলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিজের স্ত্রী’র জন্য তৈরি করে দিলেন বিশেষ শাড়ি, একেবারে বিদেশি কায়দায়। একের পর এক বই পড়াতে লাগলেন তাঁকে। সবরকমভাবে তৈরি করলেন জ্ঞানদানন্দিনীকে। পরবর্তীকালে এই জ্ঞানদানন্দিনী দেবীই বোম্বে গিয়ে আবিষ্কার করলেন শাড়ি পরার নিত্য নতুন কৌশল। তাঁর হাত ধরেই পোশাকের আধুনিকতা প্রবেশ করল বাংলার নারীসমাজে। সে এক দিন বদলের অধ্যায়…
আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হাত ধরেই আদালতে ঢুকেছিল বাংলা ভাষা
আর সেই শাড়ি পরার জন্য, বিলেতে যাওয়ার জন্য সত্যেন্দ্র-জ্ঞানদা’কে কম কথা শুনতে হয়নি। ঠাকুরবাড়িতে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল তাঁদের। শেষমেশ বির্জিতলাও-এ বাড়ি তৈরি করে চলে গিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে স্ত্রী, আর দুই সন্তান। ঠাকুর পরিবারের ভাঙনটা যেন বাড়তে লাগল। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর না থাকলে নারী স্বাধীনতা, নারী জাগরণের নতুন ঢেউ কি আসত!
তথ্যসূত্র -
১) ‘মেমদের মতো গড়ের মাঠে বেড়াতে যাবি?’, চিরশ্রী মজুমদার, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর’, সব বাংলায়
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
অলংকার-সমেত প্রতিমার বিসর্জন, এমনই বৈভব ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোয়