গান শিখেছেন অতুলপ্রসাদের কাছে, বাসি খাবার খেতে যেতেন উত্তমকুমারের বাড়িতে

তিনি হতে পারতেন অসাধারণ একজন গায়ক। তাঁর গানের গলার প্রশংসা করেছিলেন নানা জনে। হয়ে গেলেন অভিনেতা। বাংলা এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র জগত তাঁকে মনে রেখেছে এভাবেই। কিন্তু একবার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রস যাঁর ভেতরে প্রবেশ করেছে, তিনি কি এত সহজে সেসব ছেড়ে বেরোতে পারেন? নামের মধ্যেই নিয়েছিলেন পাহাড়; মনটিও ছিল পাহাড়ের মতো বিশাল। ভিড়ের মধ্যে থাকা হাসিখুশি এই মানুষটি সযত্নে লুকিয়ে যেতেন ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টকে।

এমনই ছিলেন নগেন্দ্রনাথ সান্যাল। বাংলা সিনেমা জগতের এক কিংবদন্তি। ঠিক চিনতে পারলেন না? সেটাই স্বাভাবিক অনেকের কাছে। পাহাড়ী সান্যালের আসল নামটাই যে চেপে গেছে পাহাড়ের আড়ালে! অবশ্য তাতে বিশেষ কোনো দুঃখ নেই। বেঁচে থাকলে, এটা নিয়ে হয়ত মজা করে কিছু মন্তব্যও করতেন তিনি…

জন্ম হয়েছিল সেনা পরিবারে। বাবা ছিলেন আর্মিতে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কর্মসূত্রেই যেতে হত। তখনই পাহাড়ে তাঁর ঘরে এল ‘পাহাড়ী’। এরপর লখনউতে বড়ো হওয়া তাঁর। সেখানের সমৃদ্ধ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ঘরানার সংস্পর্শে এসে জীবনের প্রথম প্রেমটি করলেন। চিরটা কাল এই সঙ্গীতের কাছেই নাড়া বেঁধেছিলেন তিনি। তবে শখের নয়; রীতিমতো উস্তাদ, পণ্ডিতদের কাছে তালিম নেওয়া গলা তাঁর। শুধু গলা নয়, সঙ্গে ছিল তবলাও।

গানের সূত্রে কার সঙ্গে আলাপ হয়নি তাঁর? উস্তাদ মহম্মদ হোসেন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ভীমসেন যোশী - তালিকাটি অনেক লম্বা। তবে আরও একজন ছিলেন তাঁর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে। অতুলপ্রসাদ সেন। যুদ্ধে যাওয়ার পর নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন বাবা। পরে আসে মৃত্যু সংবাদ। সেই সময়ই আসেন অতুলপ্রসাদ। তাঁর পরিবারের খুব আপন হয়ে গিয়েছিলেন পাহাড়ী সান্যাল। গানপাগল এই ছেলেটিকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন তিনি। নিজের বহু গান তুলিয়েছিলেন। এই অদ্ভুত ভালোলাগার সম্পর্কটি ছিল শেষ পর্যন্ত। একপ্রকার পিতা-পুত্রের সম্পর্কই রয়ে গিয়েছিল সেখানে…

নিজের সঙ্গে আস্ত একটা লখনউ নিয়ে চলতেন পাহাড়ী সান্যাল। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি টিপটপ থাকতেন। মনের মতো সঙ্গী হলে সামান্য মদ; নয়তো দামি সিগারেট আর পান। মেজাজটাই ছিল রাজার মতো। মনটাও ছিল সেরকম। তিরিশের দশক থেকে অভিনয় জগতে আসা। সেই সময় দাপিয়ে অভিনয় করছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, কে এল সায়গল, কানন দেবী-র মতো স্বনামধন্য গায়ক-নায়কেরা। সেই জগতেই নিজের তেজ নিয়ে পা রাখলেন পাহাড়ী। নায়ক হিসেবে যেমন জোরদার, তেমনই গানের দিক দিয়েও। কিন্তু গায়ক হিসেবে তাঁকে কেউ পেল না সেরকমভাবে, এটাই যা আশ্চর্যের।

বিশেষ সখ্য ছিল উত্তমকুমারের পরিবারের সঙ্গে। উত্তমের বাবা ও মা-র সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। ওঁর বাড়িতে এলেই বায়না থাকত একটি বিশেষ পদের, বাসি খাবার। অনেকেই হয়তো চমকে যাবেন। স্বয়ং উত্তম কুমারের বাড়িতে পাহাড়ী সান্যাল যেতেন বাসি খাবার খেতে! ব্যাপারটা আসলে বাংলার একটি নিজস্ব লোকাচার। মনসা পূজা উপলক্ষে অরন্ধন হলে, আগের দিনের রান্না করা ‘বাসি’ খাবার খাওয়ার নিয়ম অনেক বাড়িতে। সেরকমই খাবারের ভক্ত ছিলেন পাহাড়ী সান্যাল। যতই বাসি বলে লোকে খোঁটা দিক না কেন, তাঁকে আটকায় কার সাধ্য!

নিজের অভিনয় জীবনে কল টাইম মিস করেননি কোনোদিন। এই ব্যাপারে ওঁর ছিল প্রবাদপ্রতিম নিষ্ঠা। ১১টায় সময় দেওয়া থাকলে, কাঁটায় কাঁটায় ১১টাতেই ঢুকতেন তিনি। ঢুকেই তাঁর হুকুম ছিল একটি লুঙ্গি দেওয়ার। মেকআপ করবেন যে! তারপর ঢুকে যাবেন চরিত্রের মধ্যে। তাঁর সেই অভিনয় নিয়ে বিশ্লেষণ করা মানে ধৃষ্টতা। সারা সময় হাসিখুশি, মজা করা মানুষটা একবারও বুঝতে দিতেন না, ভেতরে ভেতরে কতটা ভেঙে আছেন তিনি। প্রেমের কাঙাল তো ছিলেনই। স্ত্রী মীরাদেবী অসুস্থ হওয়ার পর যেন ভেঙে গিয়েছিলেন আরও বেশি। শেষের দিকে আর্থিক কষ্টও সঙ্গ ছাড়েনি। কিন্তু কোথাও, এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে দেননি। মঞ্চেই নিজেকে উজাড় করে দিতেন। শেষে, সেই মঞ্চেই টের পান শেষের ডাক। অসুস্থ হয়ে পড়েন। সালটা ১৯৭৪। ১০ ফেব্রুয়ারি, সমস্ত হাসি, কষ্টের অবসান। গানের দেশের পাহাড় হয়ে গেলেন পাহাড়ী সান্যাল…

ঋণ-
১) উত্তমকুমারের প্রিয় তারকারা, সুমন গুপ্ত
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৭, ‘দিগভ্রান্ত এক বিরহী পথিক পাহাড়ী সান্যাল’                     

More From Author See More