এই বাংলার বুকেই মারা গিয়েছিলেন বাংলার যুবরাজ। কিন্তু তাঁর সমাধি স্থাপন করা হয়েছে সুদূর দিল্লির উপকণ্ঠে। আসলে যুবরাজের বসবাস ছিল দিল্লিতেই। 'বাংলার যুবরাজ' উপাধি দিয়েছিলেন তাঁর পিতা সম্রাট ইলতুৎমিস। বখতিয়ার খিলজির শাসন থেকে বাংলাকে নিজের অধিকারে এনেছিলেন দাস বংশের যুবরাজ নাসিরউদ্দিন মামুদ। ইলতুতমিশ তাই খুশি হয়ে যুবরাজকে এই উপাধি দিয়েছিলেন। আর সেটাই যেন তাঁর জীবনের সঙ্গে চিরদিনের মতো এক হয়ে গেল। যুবরাজ থেকে আর কোনোদিন রাজা হতে পারলেন না তিনি। বাংলার বুকেই আততায়ীর হাতে খুন হলেন নাসিরউদ্দিন। খবর পেয়ে সুলতানের বাহিনী এসে পৌঁছল। তারপর সেই মরদেহ নিয়ে যাওয়া হল দিল্লিতে।
দিল্লি ঘুরতে গেলে কুতুব মিনার দেখতে তো সবাই যান। কিন্তু নাসিরউদ্দিনের সমাধির খবর রাখেন না অনেকেই। অথচ ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে স্থাপিত এই সমাধিই দেশের প্রথম ইসলাম সমাধি। অন্তত তার আগের কোনো সমাধির উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। পূর্ববর্তী সুলতানদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের স্বদেশে সমাধিস্থ হয়েছেন। হ্যাঁ, ভারতবর্ষ তো তাঁদের কাছে ছিল নিছক সাম্রাজ্য। নিজের দেশ নয়। কিন্তু দাস বংশের শাসক ইলতুৎমিস এই সাম্রাজ্যকেই নিজের দেশ বানিয়ে ফেললেন। এদেশে তাঁকে সামান্য ক্রীতদাস থেকে একজন সুলতান বানিয়েছে। এটাই তো তাঁর আরেক জন্মভূমি। তাই নিজের জ্যেষ্ঠ সন্তানের সমাধিও স্থাপন করলেন এখানেই।
১২২৯ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ সমাধিস্থ হলেও তাঁর স্মৃতিসৌধ বানাতে লেগে গিয়েছিল আরও ২ বছর। ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে সেই কাজ শেষ হয়। সাদা মার্বেল পাথরের ফটকে আরবি অক্ষরে স্পষ্ট লেখা আছে মৃতের নাম, মৃত্যুর দিন সবই। তবে স্থানীয় মানুষদের কাছেও নাসিরউদ্দিন নামটা তেমন পরিচিত নয়। তাঁদের কাছে এই সৌধের নাম সুলতান ঘড়ি। কোন সুলতান? জানেন না কেউই। বরং তাঁরা বিশ্বাস করেন, এখানে কোনো এক পির বাবার সমাধি রয়েছে। আর তার উপর এই সৌধটা আসলে একটা দরগা। মাঝখানের অষ্টভুজ বেদীর উপর মনস্কাম পূরণের আশায় সিন্নি চড়ান হিন্দু-মুসলমান সকলেই। বিয়ের পর নবদম্পতি আশীর্বাদ নিতেও হাজির হন সেখানে। অথচ এই পিরের ইতহাস জানা যায় না কিছুই।
এই রহস্যই আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে বেদীর নিচে অবস্থিত সমাধিক্ষেত্র। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে প্রথমে একটি অন্ধকার লাগতে পারে। ক্রমশ চোখ অভ্যস্ত হয়ে এলে স্পষ্ট দেখতে পাবেন, পাশাপাশি তিনটি সমাধি শায়িত আছে সেখানে। সবথেকে বড়োটি নিশ্চই নাসিরউদ্দিন মামুদের। কিন্তু বাকি দুটির সম্মন্ধে ইতিহাস নিরব। তাঁর পরিবারের অন্য কারোর সমাধি, এই মতও গ্রহণ করা চলে না। কারণ প্রত্যেকেরই পৃথক পৃথক সমাধির কথা জানা। তাহলে কি সত্যিই কোনো পির আড্ডা গেড়েছিলেন এখানে? তাঁর মৃত্যুর পর যুবরাজের পাশেই শায়িত করা হয়েছিল মরদেহ? কিন্তু তার কোনো হদিশই আমাদের জানা ইতিহাস দিতে পারে না।
আরও পড়ুন
বিস্মৃতির অতলে শেষ মোঘল রাজকুমার ফিরোজ শাহ, বেগমের মাসোহারা মাত্র পাঁচটাকা
কালের নিয়মে ইতিহাসের অনেককিছুই হারিয়ে যায়। কিন্তু তার গতি প্রবাহিত হয় ভবিষ্যতের মধ্যেও। একদিন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এদেশে এসেছিলেন যে মুসলমান সম্প্রদায়, তাঁরাই হয়ে উঠলেন নিখাদ ভারতীয়। আজ দেশের এক অংশের মানুষের অন্ত্যেষ্টি হয় শ্মশানে, আরেক অংশের মানুষ স্থান পায় গোরস্থানে। অবশ্য সমাধিস্থ করার প্রথা ভারতে আগেও ছিল। ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ছাড়াও কম ধর্মীয় জাতি ও উপজাতির অস্তিত্ব তো ছিল না এদেশে। তাঁদের অনেকেই মৃত্যুর পর মৃতদেহ মাটির নিচে পুঁতে ফেলতেন। কিন্তু কবর, বা মুসলমান কবর যাকে বলে; এদেশে তার প্রাচীনতম উদাহরণ এই সুলতান ঘড়ি। অথচ দীর্ঘদিনের অযত্নে ও অবহেলায় তার অবস্থা এখন চোখে দেখা যায় না। উৎসাহী পর্যটকদের দরগার ফটক পর্যন্ত পৌঁছতে গেলে অনেক কাঁটাঝোপ পেরিয়ে তবে যেতে হয়। অবশ্য এভাবেও প্রতি সপ্তাহে কয়েক'শ পর্যটক ভিড় জমান এখনও। দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির মিলেমিশে যাওয়ার ইতিহাস খানিকটা হয়তো এখানে এসে অনুভব করতে পারেন তাঁরা।
আরও পড়ুন
মুঘল সম্রাটের সঙ্গে নির্বাসনে তাঁর বেগমও, রেঙ্গুনেই কাটালেন শেষ ২৮ বছর
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ঔরঙ্গজেব হত্যা করেছিলেন তাঁকে, মুঘল রাজপুত্র দারা শিকো-র ‘বিলুপ্ত’ সমাধির খোঁজ