নিশ্চিত নিরাপদ জীবন ছেড়ে বিচিত্র পেশার দিকে পা বাড়ানো মানুষের সংখ্যা এই পৃথিবীতে কম নয়। অথবা চেনা পেশার মধ্যে থেকেই অনেকে হয়ে উঠেছেন ব্যতিক্রমী। ঠিক তেমনই একজন মানুষ পুরনো ঢাকার (Dhaka) রাজেশ সেন (Rajesh Sen)। তিনি একজন ফটোগ্রাফার (Photographer)। কিন্তু এটুকু বললে তাঁর পরিচয় ঠিক বোঝানো যায় না। ফটোগ্রাফাররা সাধারণত বিশেষ কোনো ধরনের ছবি তোলাকেই বেছে নেন। রাজেশ তেমনই তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হিসাবে বেছে নিয়েছেন মৃত মানুষদের। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কাজটাই করে চলেছেন তিনি।
রাজেশের এই পেশায় প্রবেশের কাহিনিটিও বেশ অদ্ভুত। বাংলার হিন্দু পরিবারে মৃত মানুষের স্মৃতিচিহ্ন রেখে দেওয়ার রীতি বহু প্রাচীন। ক্যামেরার যুগের আগে মৃতের পায়ের ছাপ বাঁধিয়ে রাখতেন মানুষ। এরপর শুরু হয় মৃতের ছবি, বিশেষ করে মৃতের পায়ের ছবি তুলে বাঁধিয়ে রাখার রীতি। তবে তখন তো ঘরে ঘরে স্মার্টফোন ঢুকে পড়েনি। তাই যে কোনো ছবি তুলতে গেলে পেশাদারর ফটোগ্রাফারদের কাছেই যেতে হত। শহর, মফস্বল এমনকি গ্রামেগঞ্জেও থাকত বেশ কিছু স্টুডিও। তেমনই একটি স্টুডিওতে কাজ করতেন রাজেশ সেন। ছবি তোলার নয়। ছবির অর্ডার নেওয়া এবং রিসিট তৈরির কাজ করতেন তিনি। বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে নানারকম ছবি তোলার অর্ডারই আসত। কিন্তু মৃতদেহের ছবি তোলার অর্ডার এলেই তা বাতিল করতেন স্টুডিওর মালিক।
ঠিক এই সময় রাজেশবাবু ঠিক করলেন তিনি নিজেই ছবি তোলা শিখবেন। কিছুদিনের মধ্যেই ক্যামেরায় হাত পাকিয়ে ফেললেন তিনি। এরপর ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি মৃতদেহের ছবি তোলার কাজ করে চলেছেন। এছাড়াও অন্যান্য কাজ করেছেন তিনি। বিয়েবাড়ি বা অন্যান্য অনুষ্ঠানবাড়ির ডাকও ফেরাননি। তবে সেইসব ছবি অন্যান্য ফটোগ্রাফাররাও তুলতেন। মৃতদেহের ছবি কেউই তুলতে চাইতেন না। এই কাজের জন্য কেবল তিনিই ছিলেন। তবে ছবি তোলার কাজটা শিখেছিলেন ভালোবেসেই। বেশ কিছু সিনেমাতেও স্টিল ফটোগ্রাফারের কাজ করেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ‘হাসু আমার হাসু’, ‘সীমার’ প্রভৃতি ছবি।
তবে প্রযুক্তি যত সহজলভ্য হয়ে উঠেছে, ততই কাজ হারিয়ে ফেলেছেন রাজেশবাবুর মতো মানুষরা। ২০০৮ সাল নাগাদ তিনি নিজেই ছবি তোলার কাজ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃতের আত্মীয়দের অনুরোধে তা ছাড়তে পারেননি। অথচ এখন আর কাজ আসে না তাঁর কাছে। ২০১৮ সালে মৃতদেহের ছবি তোলার শেষ কাজ করেছেন। তারপর আর কেউ ডাকেননি তাঁকে। এখন জীবিকার তাগিদে শাঁখারীবাজারে একটি বইয়ের দোকানে কাজ করেন রাজেশবাবু। তবুও নিজেকে ফটোগ্রাফার পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন তিনি। এই পেশার সঙ্গে যে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক!
আরও পড়ুন
আধুনিকতার যুগে ব্রাত্য তারা, শতাব্দীপ্রাচীন স্মৃতি নিয়ে ধুঁকছে কলকাতার ‘সি ব্রস স্টুডিও’
তথ্যসূত্র - ‘শাঁখারীবাজারের রাজেশ সেন কেন চল্লিশ বছর ধরে লাশের ছবি তুলছেন?’, BBC বাংলা
আরও পড়ুন
অন্ত্যেষ্টি থেকে পারলৌকিক ক্রিয়া— মৃত্যুর পরে ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ কলকাতার বুকেই
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের মৃত্যুস্মারক উদ্ধার, জানা যাবে বিজয়নগরের অজানা ইতিহাস