মীরজাফর থেকে হেস্টিংসের ভূত— বিচিত্র ইতিহাসের সাক্ষী আলিপুরের বেলভেডিয়ার

বলা হয়, এই কলকাতার অলিতে গলিতে নাকি লুকিয়ে আছে আরও অনেক কলকাতা। আরও অনেক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের খোঁজে শুরু হয়েছিল আমাদের যাত্রা। যাত্রার পথে পড়েছে কত স্থাপত্য, কত নিদর্শন। কিন্তু ইতিহাস, পরাধীনতা, ঐতিহ্য, ভূত, বর্তমান এবং গুপ্তধন— এই সমস্ত কিছু একই সঙ্গে কোনও জায়গায় খুঁজে পাওয়া গেছে? অনেকের কাছে অনেক হদিশ থাকলেও খোদ কলকাতায় এরকমই একটি জায়গা রয়েছে। প্রাচীন, গাম্ভীর্যময় একটি স্থাপত্য, আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে নানা মিথ, নানা গল্প। হ্যাঁ, এবার আমাদের গন্তব্য বেলভেডিয়ার হাউজ।

আলিপুর চিড়িয়াখানার কাছেই অবস্থিত এই বিশাল সাদা রঙের বাড়িটি। ন্যাশনাল লাইব্রেরির অন্যতম হেরিটেজ একটি বিল্ডিং। রাজকীয় এই বাড়িটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের ‘ফার্স্ট হোম’। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাড়ি ছিল। তবে এই বাড়ি সম্পর্কে শোনা যায় আরও একটি ইতিহাস। কেউ কেউ বলেন, প্রথমে এই বাড়িটি ছিল মীরজাফরের। ব্রিটিশদের সাহায্যে সিরাজকে গদিচ্যুত ও হত্যা করার পর তিনি মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ব্রিটিশদের বিশাল অঙ্কের টাকার দাবি তিনি মেটাতে পারেননি। ফলে সিংহাসন ছাড়তে হয়। তখন তিনি আলিপুরের এই বাড়িতে চলে আসেন। পরবর্তীতে মীরজাফরই নাকি উপহারস্বরূপ এই বেলভেডিয়ার হাউজ ও এলাকাটি ওয়ারেন হেস্টিংসকে দিয়ে দেন।

বলাই বাহুল্য, বাড়িটি হেস্টিংসের অত্যন্ত কাছের ছিল। গোটা স্থাপত্যে রয়েছে ইতালিয়ান রেনেসাঁর ছোঁয়া। হেস্টিংসের মৃত্যুর পর এই বাড়িটি ব্রিটিশ গভর্নরদের সরকারি আবাসস্থল ছিল। সেট অবশ্য ১৯১১ সাল পর্যন্ত। তবে তারপরেও ভাইসরয়দের কলকাতার আবাসস্থল ছিল এটি। স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল লাইব্রেরির একটি অংশ হয়ে পড়ে এটি। ইতিহাসের পর ইতিহাস সজ্জিত থাকে এইখানে।

তবে কি শুধুই ইতিহাস? তার শরিকরা কি কখনও উঠে আসেন না এখানে? বেলভেডিয়ার হাউজকে ঘিরে যে মিথগুলো তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে একটি অবশ্যই এর ভৌতিক জনপ্রিয়তার জন্য। কখনও ঘোড়ার পিঠে স্বয়ং হেস্টিংস দৌড়ে যান, কখনও হেস্টিংস-পত্নী হাঁটাচলা করেন ঘরের মধ্যে। সন্ধ্যের পর আজও কয়েকজন রীতিমত এড়িয়ে চলে এই বাড়িটা। এমন অদ্ভুত ‘ঐতিহাসিক’ সহাবস্থান কি দেখা গেছে আগে? এছাড়াও রয়েছে গুপ্তধনের মিথ। ২০১০ সাল। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে বেলভেডিয়ার হাউজে। হঠাৎই এই সময় একটি গুপ্ত কক্ষের হদিশ পাওয়া যায়। একেই এত পুরনো বাড়ি, ঐতিহাসিক, তার ওপর শোনা যায় এখানে নাকি মীর জাফর থাকতেন। ব্যস, গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে গেছেন বলে লাফিয়ে উঠলেন অনেকে। তার ওপর ঘরটাও নাকি ভারী অদ্ভুত। কোনও দরজা নেই, জানলা নেই, ঢোকার কোনও উপায় নেই। সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। অবশ্য সেসব গুজবই ছিল। কারণ কিছুই পাওয়া যায়নি। কক্ষটা তৈরিই হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কারণে, ভিত মজবুত করার জন্য।

এখন শুধু বই নয়, বেলভেডিয়ার হাউজে জায়গা পেয়েছে পুরাতত্ত্বও। ভারতীয় যাদুঘরের বেশ কিছু নিদর্শন ঠাই পেয়েছে সেখানে। একের পর একে ইতিহাসের পরত পড়ে বেলভেডিয়ার হাউজ নিজেই আজ ইতিহাস হয়ে আছে।

Latest News See More