প্রতিবাদী সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করতে বিমান ‘হাইজ্যাক’ বেলারুশের!

গ্রিসের এথেন্স শহর থেকেই উড়ান দিয়েছিল ফ্লাইট এফআর-৪৯৭৮। গন্তব্য লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াস। ১৬ ঘণ্টার পথে অধিকাংশটাই নির্বিঘ্নে পেরিয়ে এসেছিল বিমানটি। তবে বাধ সাধল অবতরণের ঘণ্টা খানেক আগে। হঠাৎ আক্রমণ করে বসল মিগ-২৯ ফাইটার জেট। চমকে গিয়েছিলেন বিমানচালক নিজেও। পথ ভুল করে কি অন্য দেশের সীমায় ঢুকে পড়লেন তিনি? নাকি যুদ্ধ বাঁধল নতুন করে? সবটাই অস্পষ্ট ছিল তাঁর কাছে। শেষ পর্যন্ত ‘হুমকি’ মেনেই ফাইটার জেটটিকে অনুসরণ করতে হয় তাঁকে। অবতরণ করতে হয় বেলারুশের রাজধানী মিনস্কের বিমানবন্দরে। কিন্তু এমন ঘটনার কারণ কী?

কারণ আর কিছুই না। ওই বিমানেই লিথুয়ানিয়া যাত্রা করছিলেন বেলারুশের সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচ। আর তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্যই এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসল বেলারুশ সরকার। পথ ঘুরিয়ে রাজধানীতে অবতরণ করতে বাধ্য করল ১৭১-জন যাত্রীবাহী আস্ত একটি বিমানকে। 

গত বছর থেকেই সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে একাধিকবার উঠে এসেছে বেলারুশের কথা। ইউরোপের শেষ ‘একনায়কতন্ত্র’-এর দেশ বেলারুশ এখনও অগ্নিগর্ভ। গত বছর নির্বাচনের আগে থেকেই চলছে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলন। পাল্লা দিয়ে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারও। কারাবন্দি হাজার হাজার মানুষ। সেইসঙ্গে গুলিতে নিহতও হয়েছেন বেশ কিছু মানুষ। কেড়ে নেওয়া হয়েছে সাংবাদিকদের স্বাধীনতাও। তবে নির্বাচনের ফলাফলে এই ঘটনার ছাপ প্রতিফলিত হয়নি বিন্দুমাত্র। হবেই বা কী করে? ভোট কারচুপির মাধ্যমে যে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। পরিবর্তে দেশ ছাড়তে হয়েছিল বিরোধী দলনেত্রী স্বেতলানা তিখানোভস্কায়াকে। সেসময় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে রীতিমতো ঝড় তুলেছিলেন সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচ। প্রাণ বাঁচাতে তাঁকেও দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল গ্রিসে। 

তবে রক্ষা পাওয়া গেল না পালিয়েও। আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময়ই বলপূর্বক তাঁর বিমানের গতিপথ ঘোরাতে বাধ্য করল বেলারুশ প্রশাসন। এদিন অবতরণের পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যদিও সাফাই গেয়েছেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করেই জানিয়েছেন, বো মাতঙ্কের কারণে জরুরি অবতরণ করানো হয়েছে বিমানটির। তবে অনুসন্ধান চালিয়েও বিমানে কোনো বোমা পায়নি পুলিশ বাহিনী। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যদি বিমানে বোমা থেকেও থাকে, তবে সেই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার সত্যিই কি রয়েছে বেলারুশের? আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী সেই ঘটনার তদন্ত করার কথা গ্রিস এবং লিথুয়ানিয়ার। 

আরও পড়ুন
একইসঙ্গে দশটি তুলি দিয়ে আঁকেন ছবি, বেলারুশের ‘অতিমানবিক’ চিত্রশিল্পীর গল্প

স্বৈরাচারী শাসকের এমত কাণ্ডকারখানায় হতবাক গোটা বিশ্ব। তীব্র নিন্দা করেছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, লিথুয়ানিয়া, গ্রিস, জার্মানি-সহ একাধিক দেশ। তোপ দেগেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও। কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার এই ঘটনাকে অবৈধ ও ঘৃণ্য বলেই অভিহিত করেছেন। হাইজ্যাকের থেকে এই ঘটনা কম কিছু নয় বলেই, অভিমত তাঁর। 

আরও পড়ুন
৩০ বছর আগে প্রয়াত শিল্পীর গানেই স্বৈরাচার থেকে মুক্তির স্বপ্ন বুনছে বেলারুশ

অন্যদিকে একজাইল থেকেই আশঙ্কার জাল বুনছেন বেলারুশের বিরোধী দলনেত্রী স্বেতলানা। শুধু গ্রেপ্তারই নয়। তাঁর আশঙ্কা, প্রাণনাশের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে সাংবাদিক রোমান প্রোতেসেভিচের সঙ্গে। তবে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে ন্যাটো। ঘটনার পরেই আন্তর্জাতিক বিধি লঙ্ঘনের কারণে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়ে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। আজ ভোররাতেই বেলারুশের সঙ্গে গোটা ইউরোপের বিমানসংযোগ সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। এখন দেখার বহুমুখী এই চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বেলারুশ সরকার সিদ্ধান্ত বদল করে কিনা…

আরও পড়ুন
আন্দোলন তুঙ্গে, পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহিলাদের মানবপ্রাচীর বেলারুশে

Powered by Froala Editor