‘ভূত’ হয়ে নিজেই নিজের হত্যাকারীকে ধরিয়ে দেন ফিশার সাহেব!

বাঙালির ভূতের গল্পের ভাঁড়ার ছোটো নয় মোটেই। বৈচিত্রেও তার জুড়ি মেলা ভার। তবে বাংলা তথা ভারত থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অস্ট্রেলিয়ায় (Australia) প্রচলিত রয়েছে এমনই এক ভৌতিক কাহিনি, যা শুনলে শুধু ভীতই নয়, বিস্মিতও হবেন যে-কেউ। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই কাহিনি মনগড়া নয়, বরং বাস্তবের! কী সেই কাহিনি?

বাংলা ভাষায় অস্ট্রেলিয়ার এই আশ্চর্য ভৌতিক কাহিনির নাম দেওয়া যেতে পারে ‘ফিশার সাহেবের ভূত’ (Fishers Ghost)। খুন হওয়ার পর, ভূত হয়ে ফিরে এসে তিনি নিজেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের খুনিকে। কিন্তু কে এই ফিশার সাহেব? কীভাবেই বা মৃত্যুর পর নিজের খুনিকে পাকড়াও করলেন তিনি?  

ফ্রেডরিক ফিশার (Fredrick Fisher)। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে তাঁর রমরমা ব্যবসা ছিল ইংল্যান্ডে। ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিকই। কিন্তু ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি তাঁর। ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে বেশ কিছু জাল নোট চলে আসে তাঁর কাছে। অনিচ্ছাকৃতভাবে বা নিজের অজান্তেই সেই নোটগুলি ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি। ১৮১৫ সালে এক ব্রিটিশ আধিকারিককে এমনই এক নোট দিতেই ঘটে যায় বিপত্তি। সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের বুঝতে অসুবিধা হয়নি নোটটি আদতে জাল নোট। ব্যস, তারপরই তল্লাশি শুরু হয় ফিশারের দোকানে। উদ্ধার হয় আরও বেশ কিছু জাল নোট। ফলস্বরূপ ১৪ বছরের কারাবাসের সাজা দেওয়া হয় তাঁকে। অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হয় দ্বীপান্তরে। 

অবশ্য ১৪ বছরের সাজা দেওয়া হলেও, ৭ বছর পরই, ১৮২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যান তিনি। লেখা-পড়ায় দক্ষ এবং শিক্ষিত ব্যক্তি হওয়ার কারণে তাঁকে দ্রুত মুক্তি দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া প্রশাসন। এমনকি কারাগারে সদ্ব্যবহারের জন্য ‘টিকিট অফ লিভ’-এর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার বুকে সম্পত্তি এবং জমি অধিগ্রহণের সুযোগও পেয়ে যান তিনি। এরপর স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়াতেই থাকতে শুরু করেছিলেন ফিশার। ক্যাম্পবেলটাউনে গড়ে তুলেছিলেন নিজের খামার এবং কাগজ তৈরির শিল্প। 

তবে এর ৩ বছরের মাথায়, ১৮২৫ সালে ফের কারাগারে ফিরতে হয় ফিশার সাহেবকে। স্থানীয় এক ছুতোরের সঙ্গে তর্কাতর্কির ফলাফলেই এই সাজা। অবশ্য সে-বার অপরাধ গুরুতর না-হওয়ায় মাত্র ৬ মাসের সাজা শোনানো হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু এই ছ’মাস কে রক্ষণাবেক্ষণ করবে তাঁর খামার? কে-ই বা চালাবে কাগজের ব্যবসা? 

সমাধান হিসাবে এগিয়ে আসেন তাঁর প্রতিবেশী জর্জ ওয়ারেল। ফিশারের খামার ও অন্যান্য সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনিই। এমনকি এই কাজের জন্য তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকা এবং কাজ পরিচালনার জন্য আইনজীবীর খরচপাতিও প্রদান করেছিলেন ফিশার। তবে ফিশারের অবর্তমানে বে-আইনিভাবে কাগজের নাম বদলে তিনিই হয়ে ওঠেন গোটা সম্পত্তির মালিক। 

ছ’মাস পরে ফিশার কারাগার থেকে ফিরে এলে, তাঁকে সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন জর্জ। সেখান থেকেই তৈরি হয় বিতর্ক। বেশ কয়েকবার অনুরোধ করার পরেও কাজ হাসিল না-হলেও, শেষ পর্যন্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন ফিশার। আর তাতেই ঘটে যায় বিপত্তি। সম্পত্তি আত্মস্মাৎ করার খিদে যে ততদিনে গ্রাস করেছে জর্জকে। সুযোগ বুঝে ফিশার সাহেবকে খুন করেন তিনি। 

অবশ্য ফিশার যে খুন হয়েছেন, এটা স্থানীয়রা তখনও অবধি জানতেন না কেউ-ই। ১৮২৬ সালের ১৭ জুন রহস্যজনকভাবেই নিখোঁজ হয়ে যান ফিশার। অন্যদিকে জর্জ ঘোষণা করেন ফিশার নাকি পাড়ি দিয়েছেন ইংল্যান্ডে। এমনকি যাওয়ার আগে নিজের শখের ঘোড়া ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও বিক্রি করে দিয়ে গেছেন তাঁকে। 

প্রাথমিকভাবে জর্জের এই দাবি স্থানীয়রা মেনে নিলেও, গুজব রটে সপ্তাহ চারেক পরে। জন ফার্লি নামের এক স্থানীয় ব্যক্তি এক অদ্ভুত গল্প ফেঁদে বসেন। তিনি দাবি করেন, ফ্রেড ফিশারের ভূতকে নাকি সন্ধেবেলায় দেখেছেন রেল সেতুর ওপর বসে থাকতে। আর সেই ব্রিজের তলা দিয়ে প্রবাহিত নদীর একটি বিশেষ অঞ্চলে আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিত করেন ফ্রেডের অশরীরী আত্মা। তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ফ্রেডের অবয়ব। 

ফার্লির কাহিনি নিয়ে প্রথমে হাসি-ঠাট্টা হলেও, পরে এই গল্পকে ঘিরে তৈরি হয় সন্দেহ। এমনকি তদন্ত ও অনুসন্ধানে নামে পুলিশ। আশ্চর্যজনকভাবে ফার্লির চিহ্নিত করা অঞ্চল থেকেই উদ্ধার হয় ফিশার সাহেবের দেহ। খুনের পরে খাড়ির নিচে পাঁকের মধ্যে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল সেই দেহকে। স্বাভাবিকভাবেই ফিশারের দেহ উদ্ধারের পর গ্রেপ্তার হতে হয় জর্জকে। প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করলেও, শেষে অপরাধ স্বীকার করে নেন তিনি। বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাঁকে। 

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই গল্প আজও অস্ট্রেলিয়ায় মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় ঠিকই। কিন্তু সত্যিই কি মৃত্যুর পর ভূত হয়ে ফিরে এসেছিলেন ফিশার? বাস্তবে তা কি আদৌ সম্ভব? না, বরং যুক্তিবাদীদের অনেকের বিশ্বাস, ফার্লি নিজে হত্যা করতে দেখে ফেলেছিলেন জর্জকে। তাঁর পিছু নিয়ে দেখেছিলেন, কোথায় ফিশারের মৃতদেহ সমাধিস্থ করছেন তিনি। তবে নিজের পরিচয় গোপন করে এই তথ্য প্রকাশ্যে আনার জন্যই এই গল্প ফাঁদেন ফার্লি। অথবা, ফার্লি সত্যিই ‘ভূত-রূপী’ কোনো মানুষকে দেখেছিলেন। যিনি আদতে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তবে নিজের পরিচয় প্রকাশ্যে আনবেন না বলেই হয়তো ফিশার সাহেবের ভূত সেজে বসেছিলেন রেলব্রিজের ওপর। এই সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না কোনোভাবেই। 

তবে সে যাই হোক না কেন, ফিশার-হত্যার এত এত বছর পরেও ক্যাম্পবেলটাউন শহরে আজও জনপ্রিয় ফিশার সাহেবের ভূতের গল্প। এমনকি প্রতি নভেম্বরে ক্যাম্পবেলটাউন শহরে আয়োজিত হয় ভূতেদের উদ্দেশ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান। ফিশার সাহেবের নামেই সেই উৎসবের নাম রাখা হয়েছে ‘ফিশার’স ঘোস্ট ফেস্টিভাল’। আয়োজিত হয় ভৌতিক গল্প লেখার প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে যে খাল বা খাড়িতে পাওয়া গিয়েছিল তাঁর দেহ, বর্তমানে সেটার পরিচয় ‘ফিশার’স ঘোস্ট ক্রিক’। সবমিলিয়ে নিজের খুনিকে ধরিয়ে দিয়ে রীতিমতো তারকা হয়ে উঠেছিলেন ফিশার সাহেবের ভূত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো…

Powered by Froala Editor