অতিমারী করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় যখন গোটা বিশ্ব তটস্থ, ঠিক সেই প্রেক্ষাপটেই আরও এক মারণব্যাধি নিয়ে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করলেন গবেষকেরা। আগামী দিনে যক্ষ্মার মতো মারণব্যাধি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে চলেছে আশঙ্কা তাঁদের। বিশ্বের যে সকল দেশে আবার নতুন হামলা হতে চলেছে যক্ষ্মার, তার মধ্যে আছে ভারতও। ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই তথ্য কপালে ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের। আগামী দিনে ভারতেও যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেতে চলেছে বলে জানানো হয়েছে নামি একটি বিদেশি গবেষণাপত্রে।
ইউরোপিয়ান রেসপিরেটরি জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, আগামী দিনে, বিশেষ করে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যক্ষ্মা রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে চলেছে। সমীক্ষায় যে গতিতে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে যথেষ্ট উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছে যাবে ভারতবর্ষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি। অতীতে যক্ষ্মা রোগ লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলেও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পর রাশ টানা গিয়েছিল তাতে। তারপরেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমীক্ষায় ধরা পড়েছে ভয়াবহ ছবি। বিশ্বে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর হারও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের মোট যক্ষ্মা রোগীর ২৭ শতাংশের বসবাস ভারতে, সংখ্যায় যা প্রায় ২৭ লক্ষের কাছাকাছি। আরও ভয়ের কথা হল, হদিশ মেলেনি কিংবা নথিবদ্ধ করা যায়নি আরও প্রায় ৫.৪০ লক্ষ যক্ষ্মা রোগীর। শুধু ২০১৮ সালেই ভারতে ৪.৪ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছিল যক্ষ্মা। তাই যখন বলা হচ্ছে ভবিষ্যতে পরিস্থিতিটা আরও খারাপ হতে চলেছে, তখন তার বাস্তব রূপটা চিন্তা করেই প্রমাদ গুনছেন স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিশেষজ্ঞেরা। সমীক্ষা মতে, যক্ষ্মার ফলে শুধু ভারতেই মৃত্যু হতে পারে লক্ষাধিক মানুষের।
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে বারবারই অভিযোগ উঠেছে যে, হাসপাতালগুলিতে করোনা রোগীদের বিশেষ চিকিৎসার জন্য প্রায় পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশেও প্রতিদিনই সামনে এসেছে সাধারণ অসুস্থতাতেও ন্যূনতম চিকিৎসা না পেয়ে বেঘোরে মৃত্যুর খবর। প্রায় থমকে গিয়েছে অন্যান্য অসুখ-বিসুখ সংক্রান্ত গবেষণার চিত্রটাও। স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ম্যালেরিয়া প্রোগ্রামের প্রধান ডক্টর পেদ্রো এল আলোন্সো জানিয়েছেন যে, যক্ষ্মা বা ম্যালেরিয়ার মতো অসুখ-বিসুখগুলিকে দীর্ঘদিন ধরে সামলানোর পরেও বর্তমান করোনা পরিস্থিতি আমাদের আবার কুড়ি বছর পিছনে ঠেলে দিল। সব পরিকল্পনা আবার নতুন করে শুরু করার প্রয়োজন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
পৃথিবী থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করার লক্ষ্যমাত্রা ২০৩৫ সাল স্থির করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভারতে বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ যক্ষ্মা মুক্ত করার কথা জানিয়েছে। কিন্তু যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে, দীর্ঘদিন লকডাউন এবং কর্মহীনতার ফলে বেড়েছে মানসিক দুশ্চিন্তা ও অপুষ্টিজনিত রোগের হার, সেখানে কী করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে যক্ষ্মা নির্মূল করা সম্ভব, প্রশ্ন তুলেছেন গবেষকেরা। করোনা আবহে, বর্তমান শাসক দল ভুলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে যে, ২০১৯ সালের ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী বিশ্বে ১০২ নম্বর ছিল ভারতের স্থান। পাকিস্তান, বাংলাদেশ এমনকি নেপালও ছিল ভারতের আগে। অপুষ্টিই যক্ষ্মার মূল কারণ, সেই কথা বারবারই বলা হয়েছে চিকিৎসকদের তরফে।
তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে যক্ষ্মা ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত একটি আলোচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারংবার বলেছে এই অতিমারীর সময়েও যক্ষ্মা প্রতিরোধের কাজ যেন বন্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যক্ষ্মা রোগী এবং স্বাস্থ্যকর্মী সকলকেই সাবধান হওয়ার বার্তা দিয়ে জানানো হয়েছে, যে সকল রোগীদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন যারা, তাদের কোনও সংক্রমণ হলে মারাত্মক হবে অসুস্থতা। কারণ, যক্ষ্মা রোগের ফলে অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমে যায় অনেকটাই।
আরও পড়ুন
মানুষ নিজেকে ‘গরু’ বলে মনে করে, চিবোয় ঘাস – রয়েছে এমন রোগের অস্তিত্বও!
এছাড়াও আরও একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে সকল দেশে যক্ষ্মা প্রতিরোধের জন্য প্রতিষেধক বা টিকা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক, সেখানে করোনা ভাইরাসের হানায় মৃত্যুর হারও তুলনায় অন্যান্য দেশের থেকে অনেক কম। তাই যত তাড়াতাড়ি করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা অবহেলা না করেও অন্যান্য রোগাক্রান্তদের স্বাভাবিক পরিষেবা ফিরিয়ে দেওয়া যায়, ততই সেটা বিশ্বের জনসাস্থ্য পরিস্থিতির পক্ষে মঙ্গল বলে জানানো হয়েছে ওই সমীক্ষায়।
Powered by Froala Editor