উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশক। আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগের কথা। এপার বাংলায় কলকাতায় বেড়ে উঠছেন ভবিষ্যতের প্রতিভাবান এক ম্যাজিশিয়ন রাজা বোস, তখন ওপার বাংলায় প্রস্ফুটিত হয় আরেক বিস্ময়-পুষ্প। ১৮৯১ সালের ২৮ জুলাই অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন যতীন্দ্রনাথ রায়। তবে ম্যাজিকের জগতে তাঁর পরিচয় ‘রয় দ্য মিস্টিক’ নামেই। যেমন ছিল তাঁর অসামান্য জাদুর দক্ষতা, তেমনই তাঁর উপস্থাপনা।
তাঁর বাবা কালীভৈরব রায় ছিলেন ধামরাইয়ের জমিদারি এস্টেটের নায়েব। জমিদারি কাজেই তিনি কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দেখে এবং বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হন তিনি। দীক্ষিত হন নিরাকার ব্রহ্ম ধর্মে। তবে এইসব ধর্মচর্চার থেকে খানিকটা দূরেই থাকতেন যতীন্দ্রনাথ রায় ওরফে রয় দ্য মিস্টিক।
১৯০৭ সালে ঢাকা শহরে তখনকার বিখ্যাত জাদুকর এমিন সুরাবর্দির খেলা দেখেন তিনি। জেদ চেপে যায়, এই খেলা তাঁকে শিখতেই হবে। যেমনই ভাবনা, তেমনই কাজ। একদিন উপস্থিত হলেন তাঁর কাছে। কিন্তু বহু অনুরোধেও বরফ গলল না। এমিন সুরাবর্দি তাঁকে শেখালেন না জাদু। অথচ তাঁকে যে জাদুকর হতে হবে। উপায় খুঁজতে তিনি ছুটলেন ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক মির্জা আখতার আলি খাঁ’ সাহেবের কাছে। তিনি জাদুবিদ্যা না জানলেও সন্ধান দিলেন মায়ারহস্যের প্রবেশপথের। তাঁর হাতে তুলে দিলেন হফম্যানের বিখ্যাত বই মডার্ন ম্যাজিক। জীবনে সেভাবে বড়ো কারোর থেকে জাদু শেখেননি রয় দ্য মিস্টিক। তাঁর যা শিক্ষা, সবটুকুই বই থেকে। বই পড়ে রপ্ত করেছিলেন হস্তকৌশল। নিজের কাছে নিজেই ছিলেন একটা চ্যালেঞ্জ। নিজে সন্তুষ্ট না হলে চলত বারংবার প্র্যাকটিস। পাশাপাশি জাদুর দুনিয়ায় তাঁর আরেক অনুপ্রেরণা ছিলেন পিসেমশাই নগেন্দ্রনাথ নন্দী। কিন্তু তিনি কোনো বড়ো জাদুকর ছিলেন না। জানতেন সামান্য খেলা। তবে যতীন্দ্রনাথকে শুরু থেকেই উদ্যোম জুগিয়েছিলেন তিনি। আশ্চর্য লাগলেও সত্যি পরবর্তীকালে তিনি ভেন্ট্রিলোক্যুইজমও শিখেছিলেন বই পড়েই। রবার্ট গ্যানথোনির ‘ভেন্ট্রিলোক্যুইজম’ বইটি থেকেই তাঁর যাবতীয় শিক্ষা।
পড়াশোনাতে ভালোই ছিলেন। ইংরাজি ভাষায় দখল ছিল তাঁর। স্পষ্ট উচ্চারণ, তীক্ষ্ণতা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য চাকরি পেতে অসুবিধা হল না। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সেটলমেন্ট অফিসে পেলেন সরকারি চাকরি। কিন্তু সে চাকরি থাকল না বেশিদিন। বা বলা ভালো, রাখলেন না তিনি নিজেই। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে ১৯১১ সালে ছেড়ে দিলেন সেই কাজ। পাশাপাশি মনোযোগ দিলেন স্বপ্নপূরণে। জাদুকর হওয়ার যে স্বপ্ন। ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠালাভ করতে অসুবিধা হল না তাঁর। তাঁর জাদুর ক্ষমতা দেখে অধিকাংশ দর্শকই ভাবতেন তিনি অতিমানব। অনেকে ভুল করতেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ভেবে। তাঁর খেলাগুলির মধ্যে বিখ্যাত ছিল রিংস, মালটিপ্লাইয়িং বিলিয়ার্ড বল, চাইনিজ লিঙ্কিং রিং, মেন্টাল টেলিপ্যাথি, থট রিডিং, ফ্লোটিং বল, বার্ড ইন দ্য মিড এয়ার প্রভৃতি। এছাড়া ভেন্ট্রিলোক্যুইজম তো বটেই।
নিজের জাদুবিদ্যার পারদর্শিতা যেমন জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল তাঁকে, তেমন বিপদেও ফেলেছিল বহুবার। জীবনের সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে আছে বহু মজার রোমহর্ষক গল্প। ভ্রমণপ্রিয় রয় দ্য মিস্টিক একবার জাদুর পশরা নিয়ে পৌঁছেছেন বুন্দেল শহরে। ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশিই সেখানে খেলা দেখিয়ে রোজকার করাও তাঁর আরেক লক্ষ্য। শহর হলেও বুন্দেলের চেহারা আজকের পরিচিত শহরের মত নয়। বেশ ফাঁকা। গ্রামের মতোই চেহারা তার তখন। সেখানে থাকাকালীন দুপুরবেলা মাঝে মাঝেই তিনি ফাঁকা মাঠের দিকে চলে যেতেন। গাছের ছায়ায় একান্তে বসে প্র্যাকটিস করতেন ভেন্ট্রিলোক্যুইজম। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই চলত দক্ষতা পরীক্ষার। আর তার সঙ্গী ছিল দুই কাঠের পুতুল জ্যাক আর কাঞ্চা। তাদের মধ্যে মজার কথোপকথন করিয়েই মুগ্ধ করতেন তিনি দর্শকদের।
আরও পড়ুন
খাস কলকাতায় ভণ্ড সাধুর মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন ম্যাজিশিয়ান রাজা বোস
গ্রামবাসীরা তাঁকে চিনতেন মাস্টারবাবু বলেই। তাঁরা ভাবতেন মাস্টারবাবুর অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তিনি কথা বলতে পারেন ভূতের সঙ্গে। সেই গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও অনেকে দেখেছেন তাঁকে পুতুলের সঙ্গে কথা বলতে। যেন প্রেত এসে অবস্থান করছে কাঠের পুতুলে। মুখে মুখে এসব কথাই ছড়িয়ে যায় অঞ্চলে। বিপত্তি বাঁধে পাশের গ্রামের এক ছেলেকে সাপে কাটতেই। প্রথমে তাঁকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওঝা ফিরিয়ে দিতে পারেন না তাঁর প্রাণ। ডাক্তার-বদ্যি, হাসপাতালে গিয়েও ব্যবস্থা হল না কোনো। মৃতের শরীরে কীভাবেই বা প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব চিকিৎসকদের পক্ষে? শেষে মাস্টারবাবুর কথা শুনে ছুটে এলেন তাঁরা। তখন দু’দিন পেরিয়ে গেছে সেই বালকের মৃত্যু।
মাস্টারবাবুকে ধরলেন গ্রামবাসীরা। তাঁকে প্রাণ ফিরিয়ে দিতেই হবে, নাছোড়বান্দা তাঁরা। রয় দ্য মিস্টিক দেখলেন, তাঁদের বিদায় করা অসম্ভব। অথচ, না বললেও বাড়তে পারে বিপদ। অগত্যা সায় দেওয়া। মঞ্চে তাঁর অভিনয় যে নিখুঁত ছিল, তা বলাই বাহুল্য। এবার সেই অভিনয়েরই প্রয়োগ করলেন তিনি। কাঞ্চা আর জ্যাককে সঙ্গে নিয়েই নামালেন ভূত। কথাও বললেন সে ভূতের সঙ্গে। ভূত বলল, এ যে বাসি মড়া। সৎকার না হলে গ্রামের লোকেদের ঘাড় মটকাবে সে। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও লাভ হল না। আপ্রাণ চেষ্টা করে শেষে দুঃখপ্রকাশ আর হতাশার ভান করে তিনি গ্রামবাসীদের বললেন, ‘তোরা দু’দিনের বাসি মড়া নিয়ে এসেছিস! এর সৎকার কর আগে। নাহলে তো আত্মার শান্তি পাবে না।’ সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন তিনি। তবে আশঙ্কা থেকেই গেল গ্রামবাসীদের সদ্যমৃতদেহ নিয়ে হাজির হওয়ার! তাই পরদিনই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালালেন বুন্দেল থেকে।
এই ঘুরে ঘুরে পালিয়ে বেড়ানো যেমন তাঁর নেশা ছিল। তেমন জীবনের জন্যেও পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। কারণ ব্রিটিশ শক্তি তখন বুঝে গেছে বিদায়ঘণ্টা বাজতে চলেছে। তাই হিংস্রতা প্রখর করেই শক্ত করতে চাইছে মাটি। দমিয়ে রাখতে চাইছে মানুষকে। সেখানেই বিপত্তি। তিনি যে অনুশীলন সমিতির সভ্য। ব্রিটিশদের প্রত্যাশিত শিকার।
আরও পড়ুন
অস্ট্রেলিয়ায় প্রাচীন গুহাচিত্রের সন্ধান, ফুটে উঠেছে জাদুবিশ্বাস
১৯৩০-এ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন তিনি। লুণ্ঠনের পরে পুলিশের নজর এড়িয়ে ময়মনসিংহ ছেড়ে পালিয়ে যান ঢাকায়। অন্যদিকে তখন হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজছে ব্রিটিশ পুলিশ। কিছুদিন ম্যাজিক বন্ধ রাখলেন। কিন্তু সংগ্রামী সত্তাকে আটকে রাখা যায় কি? শুরু করলেন কাপড়ের ব্যবসা। বিক্রি করতে লাগলেন স্বদেশি খদ্দরের শাড়ি। পরিস্থিতি থিতিয়ে এলে তিনি পরিচয় পাল্টে আবার শুরু করেন জাদুর খেলা দেখানো। নতুন নাম নিলেন ‘রয় দ্য মিস্টিক’। খুললেন নতুন দলও। এক নেপালি ছোকরা হল তাঁর সবসময়ের ছায়াসঙ্গী। স্টেজেও তার উপস্থিতি ছিল সহকারী হিসাবে।
তবে স্বাধীনতা আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে খানিকটা হলেও আপোস করতে হল ম্যাজিকের জন্যই। ব্রিটিশদের অনুরোধে খেলা দেখালেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্কুল, কলেজ, ক্লাবে, পার্টিতে। ইংরেজ গভর্নরের সামনেও উপস্থাপনা করলেন জাদুর মায়াজাল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিচয় লুকনোর জন্য এসবের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়েছে তাঁকে। তবে অন্য কোথাও সুযোগ পেলেই জাদু মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়েই ছড়িয়ে দিতেন সংগ্রামের মন্ত্রবীজ। তৈরি করেছিলেন ‘অহিংসার জয়’, ‘অবিনাশী কংগ্রেস পতাকা’-র মত কিছু খেলা। ততদিনে ধীরে ধীরে কোথাও সহিংস আন্দোলন থেকে কংগ্রেসী অহিংসতাই জায়গা করে নিয়েছে তাঁর মধ্যে।
আরও পড়ুন
লকডাউনে বন্ধ উপার্জনের পথ, পেশা বদল করছেন জাদুকর থেকে বুকিরা
তবে ঢাকা থেকেও শেষমেশ পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। দার্জিলিং গিয়ে কাজ নেন চা-বাগানে। চা-বাগান ও হিল স্টেশনগুলিতেও ম্যাজিক দেখিয়েছেন তিনি। তার কিছুদিনের মধ্যেই দেশভাগ। স্বাধীনতার পর মুক্তির স্বাদ। খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবী পরে, স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রাজ্যপাল ডঃ কৈলাশনাথ কাটজুকে খেলা দেখালেন রয় দ্য মিস্টিক।
তবে শুধু জাদুতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না তিনি। বেশ কিছু গান রচনাও করেছেন। বেশিরভাগের সুর ছিল ভাটিয়ালি। হারিয়ে গেছে বেশিরভাগই। খুব অল্পই পাওয়া যায় তাঁর লেখা গান। শেষ জীবনে কলকাতায় চলে এসেছিলেন রহস্যময় এই জাদুকর। থাকতেন কলকাতার গলফগ্রীনে ছেলের তৈরি করা বাড়িতে। সেখানেই ১৯৭৭ সালে ২৩ জানুয়ারি মারা যান তিনি। তবে এখনো তাঁর জীবনের রহস্য অবাক করা যে কাউকে। তা স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিত্র নিয়েই হোক কিংবা ম্যাজিকের। থট-রিডারের পাশাপাশি তিনি হয়তো দূরদর্শীও ছিলেন। এত বছর পরও যে তাঁর কথায় মুগ্ধ হবেন মানুষ, সেও মনে হয় বুঝেছিলেন তিনি। তাই হয়তো ভাটিয়ালির সুরে লিখেছিলেন অন্যদের সম্ভাব্য কথাই লিখে রেখেছিলেন রয় দ্য মিস্টিক,
“জাদুকর! কী খেলা যে দেখাও তুমি, —অবাক হয়ে যাই।
বিশ্বরঙ্গের মঞ্চে বসে, রঙ্গ দেখাও ছদ্মবেশে,
লীলা তোমার বুঝতে নারি, —হাসি কাঁদি তাই,
আমি অবাক হয়ে যাই...”
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor