মিশনারি স্কুলটিতে সকাল থেকে শুরু হয়েছে ব্যস্ততা। ক্লাস তো চলছেই, কিন্তু সেইসঙ্গে একটি বিশেষ ঘটনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে স্কুল চত্বর। আজ যে এখানে আসবেন ভারতের ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’— গওহরজান! শুধু কি তাই, তাঁর গানেও যে মুগ্ধ আসমুদ্রহিমাচল! এমন মানুষ স্কুল প্রাঙ্গণে পা রাখবেন, প্রতিটা ক্লাস ঘুরে ঘুরে দেখবেন, এ তো আলাদাই ব্যাপার! অবশেষে তিনি এলেন। একজন শিক্ষিকার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন গওহরজান। হঠাৎই ওড়নায় পড়ল টান! ঘুরে দেখেন, দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ছোট্ট মেয়ে। অবাক হয়ে দেখছে ওড়নার কারুকাজ। এমন সুন্দর কাপড় এর আগে সে দেখেনি। আহা রে! এগিয়ে গেলেন গওহরজান। জিজ্ঞেস করলেন নাম। রিনরিনে গলায় ছোট্ট মেয়েটি বলল- ‘বিবি’। একটু চমকে উঠলেন গওহরজান। এই ছোটো বয়সে এত সুন্দর গলার আওয়াজ, ‘ও মেয়ে তুমি কি গান করো? একটা গান গাও না!’ ছোট্ট বিবি এর আগে কোনোদিনও গান গায়নি। অত পয়সা কোথায় তাদের! কিন্তু গওহরজান নিশ্চিত, এই মেয়ে গান শেখে। অগত্যা দু’কলি গাইল বিবি। ‘ডান্সিং গার্ল’ মুগ্ধ হয়ে শুনলেন সেই গান। আহা, কি সুন্দর করে গাইল দেখো! নিশ্চিত, এই মেয়ে একদিন বিশাল বড়ো জায়গায় যাবে। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে যাবে বিশ্ব…
কিন্তু বিবি যে গান জানে না! কিন্তু জীবনের গতিপথ খুব তাড়াতাড়িই বদলে গেল। আব্বার দেখা পায়নি সে। তাঁর আগেও নাকি বিয়ে হয়েছিল। আম্মিকে বিয়ে করে এই সংসারের দিকে ফিরেও দেখেননি তিনি। দিদি মারা গেছে সেই কবে! তখন এইটুকু সে। কিন্তু জীবনযুদ্ধে তো টিকে থাকতে হবে! আর গানও তো থাকবে সেখানে, শুরু হল উস্তাদ ইমদাদ খাঁ-র কাছে নাড়া বাঁধা। মাত্র নয় বছর বয়সে রেকর্ড করল বিবি। অবশ্য সে তখন ‘আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি’। বাকি গল্পটা এক সাধকের জন্মকথা। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল এক জীবনবোধ; যার ছত্রে ছত্রে লেগে আছেন ঈশ্বর, আছে সাধনা। আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি থেকে বেগম আখতার হয়ে ওঠার কাহিনি…
তিনি ‘মালিকা-ই-গজল’, অর্থাৎ গজলের রানি। তানপুরা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বেগম আখতার ডুবে যান অনন্ত সাগরে। মন্থনে উঠে আসে বিষ, উঠে আসে অমৃত। সাধনা তীব্র হয়। সত্য! এসবই সত্য! সেই সত্যেরই সাধক হয়ে ওঠেন বেগম সাহেবা। কেবল ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতসাধক হিসেবে তাঁকে দেখলে বোধহয় পুরোটা দেখা হয় না। বেগম আখতার প্রতিনিয়ত নিজেকে দগ্ধ করেছেন। ছাইভস্ম মেখে আবারও দাফন করেছেন নিজেকে, নিজেরই ভেতর। সেই সুরেই বেজে উঠেছে গলা। সেই মিশনারি স্কুল চত্বরের দিনটা মনে পড়ে বারবার। ঈশ্বরকে এরকম হঠাৎ করেই পাওয়া যায়। আর সৎ না হলে, সঙ্গীতের কাছে বসবেন কী করে…
নিজের প্রথম রেকর্ড বেরনোর পর সেরকমভাবে চলেনি বাজারে। আম্মি মুস্তারি ভেঙে পড়েছেন একেবারে। তাহলে কি মেয়েকে দাঁড় করাতে পারবেন না? হারিয়ে যাবে? নিয়ে এলেন এক পীরবাবার কাছে। ছোট্ট আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি দেখে তিনি একটাই কথা বললেন— এই মেয়ের সামনে একদিন গোটা পৃথিবী নত হবে। গানই হবে আরাধ্য দেবতা। সেখানেই আল্লার সঙ্গে মোলাকাত হবে ওঁর। তারপর ১৩ বছর বয়সে আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি গাইলেন ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো’। ব্যস, আর দেখতে হয়নি। এর পরের বছরই তিনি নামলেন থিয়েটারে। গান তো বটেই, এবার এই মেয়ে অভিনয়তেও জাদু দেখাচ্ছে! খবর ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। বম্বে থেকে ডেকে পাঠাচ্ছেন পরিচালকেরা। এমনকি, কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানিও তাঁকে ডাকছেন অভিনয়ের জন্য। একের পর এক ছবিতে অভিনয়ও করছেন আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি; সঙ্গে চলছে গানও। একসময় ছেড়ে দিলেন অভিনয়। বম্বে’র জীবনটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। তার থেকে নিজের সঙ্গীতের কাছেই একটু বসা যাক…
ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন মুসলিম। তিন তিনবার হজ যাত্রা করেছেন। তাই বলে কোরান শরীফেই নিজেকে উজাড় করে দেননি। বরং ঈশ্বরকে খুঁজেছেন নিজের গানের মধ্যে দিয়ে। অগুনতি ছাত্রছাত্রী তাঁর, সব ধর্মের সমান আদর তাঁর কাছে। সেখানে এক চুলও এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। ততদিনে আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি থেকে হয়ে গেছেন বেগম আখতার। তাঁর কাছে সৎ থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার। যে নিজের জীবনের কাছে সৎ নয়, সে সঙ্গীতের সাধক হবে কী করে!
প্রিয় ছাত্রীদের ডেকে মাঝেমধ্যেই বলতেন, একা বেঁচে থাকতে শেখো। ‘যদি কৃতকার্য হতে চাও, তবে একা থাকো’। জীবনে অনেক ঝড় দেখেছেন, সেই ছোট্ট থেকে কষ্ট করে বড়ো হয়েছেন। কিন্তু ভারতের সনাতন আভিজাত্য যেন তাঁর শরীর আর মনে ঝরে পড়ত। সেই বিশালত্বের কাছে মাথা এমনিই নত হয়ে আসে। তখন কি কেউ বলবে, জীবনে কতটা একা তিনি! অবশ্য নিজেই নিজেকে এমন ‘আশীর্বাদ’ দিয়েছেন। একা না থাকলে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাবে কী করে! কোথাও গিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর বেগম আখতার এক হয়ে যান এখানে। ‘বিস্ময়ে তাই জাগে’! গর্ভে বেড়ে উঠেছে মৃত সন্তানরা, সেই দুঃখ নিয়ে চলেছেন একসময়। ভেবেছিলেন, এই জীবন রেখে কী লাভ! গানও তো চলে গেছে জীবন থেকে। খাদের ধার থেকে তাঁকে টেনে তুলেছিল সেই সঙ্গীত-ঈশ্বরই। ‘মল্লিকা-ই-গজল’ কেমন করে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, এরপরও!
আরও পড়ুন
সিরাজের ভয়েই লুকনো অজস্র ধনসম্পদ! মুর্শিদাবাদের প্রাসাদ ও মুখে রক্ত ওঠার ‘গল্প’
তথ্যসূত্র-
১) ‘খাতা দেখে গান না করলে তা অন্তর থেকে আসে না’, ঋতা গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘বেগম আখতার: বেদনার সঙ্গীতময় সৌরভ’, মাহফুজ পারভেজ, বাংলা নিউজ ২৪
আরও পড়ুন
যুগলবন্দিতে পণ্ডিত যশরাজকে ডাকলেন ভীমসেন যোশী, বলিউডের গানেও মুগ্ধ তামাম শ্রোতা
৩) ‘Memories of Akhtari’, Shreya Lla Anasuya, Live Mint
Powered by Froala Editor