১৯৩৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি। তবে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে ভিতরে ভিতরে। ঠিক এই সময় টাইমস অফ ইন্ডিয়ার পাতায় প্রকাশিত হল একটি খবর। যার শিরোনাম ‘গেস্টাপো ইন ইন্ডিয়া’। হ্যাঁ, হিটলারের (Hitler) সেই কুখ্যাত বাহিনী গেস্টাপো। তা^দেরই ৫ জন সদস্য তখন শ্রীলঙ্কা থেকে মাদ্রাজ এবং মাদ্রাজ থেকে কলকাতা এসে পৌঁছেছেন। অবশ্য তাঁদের গন্তব্য নেপাল, বা বলা ভালো তিব্বত (Tibet)। সেখানেই আর্য জাতির মূল (Origin of Aryan) খুঁজতে চলেছেন ৫ জন গেস্টাপো।
হিটলার কখনও ভারতে আসেননি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। তার কারণ শুধু এটুকু নয় যে তিনি নেতাজিকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। হিটলারের লেখায় এবং বক্তৃতায় তার আগেও বহুবার ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। তবে সেই প্রসঙ্গ প্রশংসাবাচক না নিন্দাবাচক, তা বোঝা একটু কঠিন। হিটলার বিশ্বাস করতেন আটল্যান্টিস হারিয়ে যাওয়ার পর আর্যরা প্রথমেই বাসা বেঁধেছিলেন ভারতের কোনো স্থানে। তারপর সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আর সেই জায়গাটা খুব সম্ভবত তিব্বত। তবে তিনি এও বিশ্বাস করতেন, ভারত ছেড়ে যাঁরা নিজেদের জাতিগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরাই উচ্চশ্রেণির আর্য। আর যাঁরা ভারতে থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা অন্যান্য জাতির মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে মর্যাদা হারিয়েছেন।
তবে হিটলারের মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ বিশ্বাস ছিল, এখনও হয়তো কয়েকজন মানুষ থেকে গিয়েছেন, যাঁরা অনার্যদের সঙ্গে মেশেননি। আর তিব্বতের উপত্যকায় তাঁদের অনুসন্ধান করতেই পাঠানো হল ৫ জনের দলটিকে। দলের পরিচালনার কাজে ছিলেন হেইনরিখ হিমলার স্বয়ং। যদিও তিনি তো খুব একটা সুস্থ মানুষ ছিলেন না। এতদূর যাতায়াত, তার উপর তিব্বতের দুর্গম পরিবেশ – এইসব তাঁর পোষাবে না। তবে দলের নেতৃত্বে রেখেছিলেন দুজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে। একজন তরুণ প্রাণীতত্ত্ববিদ আর্নেস্ট স্ক্র্যাফার। তিনি গেস্টাপোতে যোগ দেওয়ার আগেই দুবার ভারতে ঘুরে গিয়েছেন। তিব্বতেও ছিলেন বেশ কিছুদিন। তিব্বতি ভাষাটাও মোটামুটি তাঁর জানা। ফলে সবাইকে পথ দেখানো এবং স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপরেই।
অন্য এক সদস্য হলেন নৃতাত্ত্বিক ব্রুনো বেগার। মূলত তাঁর গবেষণার উপর নির্ভর করেই আর্যজাতির শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। আর্যদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য তিনি বিচিত্র নানা তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন। আর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন আর্যদের মাথার খুলির গঠনে। স্ক্র্যাফার, ব্রুনো এবং তাঁদের দলের গবেষণার বিষয়ে অবশ্য ব্রিটিশ সরকারের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু একটা সন্দেহ থেকে গিয়েছিল, গেস্টাপোরা হয়তো গোপন খবর অনুসন্ধান করতে আসছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার খবর সেই সন্দেহকে আরও উস্কে দিয়েছিল। ফলে তাঁরা কলকাতা এসে পৌঁছানোর পর আর সরকারের তরফ থেকে কোনো সাহায্যই করা হয়নি। এমনকি সিকিমের ব্রিটিশ হাইকমিশন তো রীতিমতো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিব্বতে পৌঁছেছিলেন তাঁরা। গিয়ে দেখলেন আরেক বিপত্তি। আগের দলাই লামা সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। আর নতুন দলাই লামার বয়স মাত্র ৩ বছর। তার সঙ্গে আলোচনা করা চলে না। শেষ পর্যন্ত মঠের আরও বেশ কিছু সন্ন্যাসীর সাহায্য পেয়ে অবশ্য গবেষণার কাজ শুরু হল। তিব্বতে বেশ খাতির পেয়েছিলেন নাৎসিরা। সেই খবর হিমলারকে লেখা ব্রুনোর চিঠি থেকে জানা যায়। তবে তাঁরা তো জানতেন না যে এই অতিথিদের বিশ্বাস আর্যদের পদস্খলনের পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী বৌদ্ধ ধর্ম। জানলে হয়তো তেমন আপ্যায়ন করতেন না।
আরও পড়ুন
নাৎসিদের বিরুদ্ধে গানই অস্ত্র ‘জলদস্যু’দের, দিতে হয়েছিল প্রাণও
একের পর এক মানুষের ছবি তোলা, মাথার এবং হাত-পায়ের ছাঁচ তৈরি করার কাজ চলতে থাকল। তবে তার চেয়েও বেশি সময় ব্রুনোকে দিতে হত স্থানীয় মানুষদের চিকিৎসার জন্য। তিব্বতে ডাক্তার বলতে তো কেউ নেই। ব্রুনোই তখন অস্থায়ী ডাক্তার। যার যত রোগ, এসে দেখিয়ে যান তাঁকে। তিনিও সাধ্যমতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ভেবেছিলেন, তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। ধীরে ধীরে গবেষণা করলেই হল। কিন্তু এর মধ্যেই বেজে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘণ্টা। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ হিমলারের চিঠি পেয়ে ফিরতে হল দলকে। তিব্বত থেকে কলকাতা। আর কলকাতা থেকে বিমানে সোজা মিউনিখ।
আরও পড়ুন
নাৎসি-অত্যাচারে দেশছাড়া, ৯২ বছর বয়সে ফের অস্ট্রিয়ার নাগরিক আনা ফ্রাঙ্কের বান্ধবী
এর মধ্যে ২ হাজার মানুষের ছবি তুলতে পেরেছিলেন তাঁরা। ৩৭৫ জন মানুষের মাথার মাপ নেওয়া হয়েছিল। আর ছাঁচ তৈরি করা হয়েছিল মাত্র ১৭ জন মানুষের। তবে ফেরার সময় তিব্বতিদের কাছ থেকে উপহার হিসাবে পেয়েছিলেন প্রায় ২ হাজার প্রত্নসামগ্রী। যুদ্ধ চলাকালীনও সলৎজবার্গে হিমলারের দুর্গে বসে গবেষণা চলতে থাকে। তবে সেইসব গবেষণার নথি আর কিছুই পাওয়া যায়নি। ব্রিটিশ বাহিনী নাৎসিদের পরাজিত করে হিমলারের দুর্গ দখলের পরেই সব নষ্ট করে ফেলেছিল। এমনকি কোনো প্রত্নসামগ্রীও সংরক্ষণ করা হয়নি। তিব্বতীদের নৃতত্ত্ব সম্বন্ধে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পাওয়া যেত না সেই নথি থেকে। কিন্তু ২ হাজার তিব্বতী প্রত্নসামগ্রী নষ্ট করে ফেলার অভিযোগ আজও রাখাই যায়।
আরও পড়ুন
সিন্থেটিক ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল নাৎসি সেনারা, ‘নেশা’র অভাবেই আত্মহত্যা হিটলারের?
তথ্যসূত্রঃ When Nazis tried to trace Aryan race myth in Tibet, BBC
Powered by Froala Editor