“ওমা কালী! কালী গো! এতনি ভঙ্গিমা জান। কত রঙ্গ ঢঙ্গ কর যা ইচ্ছা হয় মন।।” – শ্যামাসঙ্গীত-প্রিয় বাঙালির কানে এই পংক্তিগুলি হয়তো একটু অচেনা ঠেকবে। আরও আশ্চর্য লাগবে, যদি শোনেন এই গানের রচয়িতা ছিলেন ধর্মে মুসলমান। নাহ, নজরুল ইসলামের কথা হচ্ছে না! হ্যাঁ, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই শাক্ত-পদকর্তা হিসাবে সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয়, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু নজরুলের অনেক আগে থেকেই অজস্র শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে এসেছেন এপার-ওপার দুই বাংলার মুসলমান কবিরা। লিখেছেন কালিকামঙ্গল কাব্যও। সম্প্রদায়-ভেদ কি কখনও সুরের সাধনায় বাধা দিতে পারে? নাহ, আমাদের সম্প্রীতির বাংলায়, সমন্বয়ের বাংলায় অন্তত তেমনটা ঘটেনি। কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন কিংবা মাতৃসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের পাশাপাশি মুসলমান কবিরাও এখানে মহাকালীর মায়ায় মজেছেন, তাঁদের গানে, তাঁদের সুরেও ধরা দিয়েছেন “শ্যামা সুধা-তরঙ্গিনী”। আজ বলব তাঁদেরই কয়েকজনের কথা।
প্রথমেই বলতে হয় চট্টগ্রামের কবি সা বিরিদ খাঁ-এর কথা। প্রসিদ্ধ গবেষক মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এঁর পরিচয় উদ্ধার করেছেন। সম্ভ্রান্তবংশীয় কবি সা বিরিদ খাঁ বড়ো হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামের শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সমাজে, সুফি সাধনার ঐতিহ্যও ছিল তাঁর মননের সঙ্গী। তিনি লিখেছিলেন বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি অবলম্বনে একখানি কালিকামঙ্গল কাব্য। মূলত মানবরসের লৌকিক কাব্য হলেও, দেবী কালীর মাহাত্ম্য এই কাব্যের অন্যতম উপজীব্য। গ্রন্থের সূচনাতেই কবি কয়েকটি স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক জুড়ে দিয়েছেন, যাতে বলা হচ্ছে কালিকা-প্রসাদেই নৃপতি গুণসার সুন্দরকে পুত্ররূপে লাভ করেন। এই আখ্যানের নামধাম ও কাহিনিতে কিছু নতুনত্বের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন। হিন্দুর পুরাণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ সম্পর্কে কবির সম্যক অভিজ্ঞতার ছাপ লেগে আছে এই কাব্যের পাতায় পাতায়।
দেবী কালীর আঁধার-মধুর রহস্যময় রূপের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসার স্পর্শ লেগেছে দুই বাংলার আরও অনেক মুসলমান কবির হৃদয়ে। তাঁরা লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত। নওয়াজিস খান, আলি রজা, আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি, মুনসি বেলায়েত হোসেন, সৈয়দ জাফর খাঁ এবং হাছন রাজার নাম এক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যায় কম হলেও, এঁদের লেখা শ্যামাসঙ্গীত এক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। গবেষক অমিয় শঙ্কর চৌধুরী এই বিষয়ে এক তথ্যবহুল এবং সুখপাঠ্য বই লিখেছেন, তার নাম ‘মুসলিম কবির শ্যামাসঙ্গীত’।
এবার, সেই কবিদের রচনার অল্পস্বল্প পরিচয় দেওয়া যাক।
কবি সৈয়দ জাফরের লেখা একটি গানের বাণী এরকম, “কেন গো ধরেছ নাম দয়াময়ী তায়/…সৈয়দ জাফর তরে/ কী ধন রেখেছ ধরে/ সম্পদ দুখানি পদ হরের হৃদয়।” জাফরসাহেবের গান একসময় রসিক শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়েছিল।
এ ব্যাপারে আরেক ওস্তাদ ছিলেন মুনসি বেলায়েত হোসেন। তিনি খাস কলকাতার মানুষ, তাঁর নিবাস ছিল শিয়ালদহে। সংস্কৃত সাহিত্যে দারুণ দখল ছিল তাঁর। তাঁর ভক্তিমূলক গান আর পদাবলির মাধুর্যে আপ্লুত সেকালের পণ্ডিতসমাজ তাঁকে ‘কালীপ্রসন্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর “বিরহ অনল আসি” গানটির শেষ দুটি লাইন, “কালী কালী বলে কালী, সহায় হইলে কালী/ নাথেরে পাইবে কালী/ ঘুচিবে এ বিরহানল।” একেবারে অন্তিম “কালী” শব্দটি স্বয়ং কবিকে ইঙ্গিত করছে। আরও অজস্র গানের শেষে তিনি “কালী” কিংবা “কালীপ্রসন্ন” অভিধাটি ভণিতা হিসাবে যুক্ত করেছেন। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক- “কালী কহে শুন সখা, সে পায় তোমারই দেখা,/ যার তুমি হও সখা এ তিন লোকেরই মাঝে।।”; “কালী কহে এই সত্য, সকলই দেখ অনিত্য,/ চিন্তা কর পরমার্থ ছেদন হবে ভববন্ধন।।”; “কালীপ্রসন্ন এই বলে, স্বর্গ মর্ত্ত্য ভূমণ্ডলে,/ চলিতেছে কালে কালে সকলই তাঁর লীলাখেলা।।” ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন মুসলমান কবির নাম আর পরিচয়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে যাচ্ছেন কালী, এ এক দুর্লভ সমন্বয়ের নিদর্শন বটে!
আরও পড়ুন
বুকের ওপর মূর্তি রেখে সাধনা; কমলাকান্তের আরাধ্য কালীই বজবজের ‘খুকি’!
আর এক কবি হাছন রাজা একইসঙ্গে মজেছিলেন শ্যাম আর শ্যামার প্রেমে, তাই তিনি লিখেছেন, “আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,/ আমি কি তোর যমকে ভয় করি।/ শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।।” কালীর অদ্ভুত লীলারসে বিভোর হয়ে তিনি গান বেঁধেছেন, “ওমা কালী! কালী গো! এতনি ভঙ্গিমা জান। কত রঙ্গ ঢঙ্গ কর যা ইচ্ছা হয় মন।।” হ্যাঁ, এই গানটার কথাই আমরা এই লেখার শুরুতে বলছিলাম! শ্যামা মায়ের প্রতি তাঁর অন্তরের আকূতি ধরা পড়েছে এই কয়েকটি পংক্তিতে, “তুমি বাড়ি, তুমি ঘর মা! তুমিই সংসার। তুমি বিনে অন্যজনা কেহই নাই আর।। নানা সময় নানা রূপে, অবতার হইয়া। ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণ কর দুষ্টকে মারিয়া।। হাছন রাজা কালী ভক্ত, কালী পদ সার। কে বুঝিতে পারে মায়ের অনন্ত ব্যাপার।।”
মির্জা হুসেন আলির শ্যামাসঙ্গীত শুনলে তো রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। “যা রে শমন এবার ফিরি” গানে তিনি একেবারে রামপ্রসাদের ঢঙে মৃত্যুবিষাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ঘোষণা করছেন। শ্যামা-প্রেমে বিভোর কবি মৃত্যুর সামনে তুড়ি মেরে নির্ভয়ে বলছেন, “আমি তোমার কি ধার ধারি,/ শ্যামা মায়ের খাসতালুকে বসত করি।/ বলে মৃজা হুসেন আলী, যা করেন মা জয়কালী,/ পুণ্যের ঘরে শূন্য দিয়ে, পাপ নিয়ে যাও নিলাম করি।।”
আর এক সাধক-কবির কথা বলি। নোয়াখালি জেলার অন্তর্গত প্রসিদ্ধ মেহের কালীবাড়ির বাসিন্দা ছিলেন ভাবোন্মত্ত সাধক কেয়ামত আলি খাঁ মুনসি। তিনি এক রহস্যসঙ্গীতে বলছেন, “হরিকে কালী বলা ভুল,/ কালীকে হরি বলা ভুল।/ আমি ভেবে ভেবে হলাম পাগল, পেলাম না তার মূলামূল।।” লালন শাহের গানেও পাওয়া যাচ্ছে কালীর উল্লেখ। “প্রেম প্রেম বলে করো কোর্ট কাচারি” গানের শেষে তিনি বলছেন, “কোন প্রেমে মা কালী/ পদতলে মহেশ্বর বলি।/ লালন বলে ধন্য দেবী/ জয় জয় হরি।।”
আরও পড়ুন
মুসলমান কারিগরদের হাতেই ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হিন্দু দেবদেবীর; কলকাতায় সম্প্রীতির ঐতিহ্য এমনই
‘প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ প্রবন্ধে দীনেশচন্দ্র সেন স্মৃতিচারণ করেছেন, “আমি নিজে দেখিয়াছি, ত্রিপুরাবাসী গোলমাহমুদ স্বীয় দলবল লইয়া স্ব-রচিত কালী-বিষয়ক নানা সঙ্গীত ঝিঁঝিট রাগিণীতে আসরে গাহিতেন। তাঁহার রচিত- “উন্মত্তা, ছিন্নমস্তা এ রমণী কা’র-” প্রভৃতি গানের রেশ এখনও আমার কানে বাজিতেছে। কিন্তু গোলমাহমুদকে মুসলমানেরা কখনও ‘কাফের’ বলেন নাই। তিনি স্বর্ধমনিষ্ঠ ছিলেন। সৈয়দ জাফর শাহের কালী-বিষয়ক গান অনেকেই জানেন।” এ এক আশ্চর্য সংহতি ও সমন্বয়ের গল্প!
মুসলমান কবির শ্যামাসঙ্গীতের কথা উঠলে যাঁর নাম আসবেই, তিনি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর লেখা “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন” গানটি শোনেননি, এমন বাঙালি সত্যিই দুর্লভ। কোনও কোনও গবেষকের মতে, সংখ্যার দিক থেকে তাঁর লেখা শ্যামাসঙ্গীতের পরিণাম কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের চেয়েও বেশি। এক আশ্চর্য প্রেমে আবিষ্ট হয়ে কাজীসাহেব গেয়েছেন, “আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম। মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু, ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম।।” আজ ভাবতেও গর্ব হয়, সাম্প্রদায়িক বেড়াজালকে হেলায় তুচ্ছ করে যেখানে এমন সঙ্গীতের স্রোত বয়ে যায়, সেই বঙ্গভূমি আমাদেরই মাতৃভূমি!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প