‘পবিত্র’ কুমিরদের সঙ্গে খেলায় মাতে এই গ্রামের মানুষেরা

এখানে নির্ভয়ে খেলা যায় কুমির-ডাঙা। তাও সত্যিকারের কুমিরদের সঙ্গে। গ্রামের বাচ্চারা নিশ্চিন্তে উঠে বসে তাদের পিঠে। একসঙ্গে স্নান করে দিঘিতে, ঘুরে বেড়ায় খালে-বিলে। কুমিররা কিন্তু ঘুরেও তাকায় না, কিচ্ছু বলে না। বরং ভালোবেসে খাবার দিলে সাড়া দেয়। গ্রামের লোকেরাও শ্রদ্ধা করে তাদের। পশ্চিম আফ্রিকার বুকরিনা ফাসো (Bukrina Faso) দেশের বাজুলে (Bazoule) গ্রামে এভাবেই কুমিরে-মানুষে বন্ধুত্ব চলছে যুগের পর যুগ ধরে।

এমনিতে কুমিরের কুখ্যাতির শেষ নেই। জলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ওত পেতে। ক্ষিপ্রগতির আক্রমণে ভবলীলা সাঙ্গ করে শিকারের। বাজুলের কুমিররা অবশ্য একেবারেই হিংস্র নয়। তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় নীল নদের কুমিরদের তুলনায় অনেক সভ্য-ভদ্র। এদের জাত আলাদা। বিজ্ঞানসম্মত নাম— ক্রোকোডাইলাস সচাস (Crocodylus Suchus)। পশ্চিম আফ্রিকার রুক্ষ-শুষ্ক অঞ্চলে এদের বসবাস। এই অঞ্চলে বড়ো নদীর খুব অভাব। থাকতে হত ছোটো নদী-ডোবার কাদামাটিতে বা শুকনো জঙ্গলে। গ্রীষ্মে বিপদ বেড়ে যেত আরও। সেই কারণেই ক্রমশ লোকালয়ের দিকে চলে আসতে থাকে তারা। ক্রমে বদল এসেছে স্বভাবেও।

বাজুলে সেরকমই এক নিশ্চিন্তির জায়গা। অকারণে তারা মানুষকে আক্রমণ করে না। গ্রামবাসীরাও সাদরে গ্রহণ করেছে তাদের। কুমিররা পবিত্র এখানে। জড়িয়ে আছে লোকবিশ্বাস। কথিত যে, গ্রামের এক পূর্বপুরুষকে নদীতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল কুমির। তারপর থেকে কুমির তাদের পূর্বপুরুষের আত্মার প্রতীকস্বরূপ। তাদের রক্ষাকর্তা। একটি শিশুর জন্মের বিপরীতে জন্ম হয় একটি কুমিরের। বৃষ্টির জলের সঙ্গে তাদের পাঠায় ঈশ্বর। তাই যেদিন গ্রাম থেকে কুমির অবলুপ্ত হয়ে যাবে, সেদিন শুকিয়ে যাবে সমস্ত জল।

প্রতি বছর গ্রামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় কুমিরদের ধন্যবাদজ্ঞাপনের জন্য। যার নাম— ‘কুম লাকরে’ উৎসব। যেখানে নিজেদের ও গ্রামের মঙ্গলের জন্য করা হয় প্রার্থনা। রাজকীয় ভোগের বন্দোবস্ত থাকে কুমিরদের জন্য। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে চলছে এই প্রথা। কয়েকশো কুমিরের সঙ্গে নির্বিঘ্নে চলছে জীবনযাপন।

আরও পড়ুন
কুমিরের পেটে ডাইনোসর! এমন জীবাশ্মের সন্ধান এই প্রথম

তবে, শুধু বাজুলে নয়। বুকরিনা ফাসো-র ছোটো শহর সাবু-তেও পবিত্র মনে করা হয় কুমিরদের। পাশের দেশ ঘানাতেও দেখা যায় একই দৃশ্য। সেখানের পাগা শহরে সংরক্ষণ করা হয় কুমিরদের। চাদ দেশের গেল্টা ডি-আর্কেই হ্রদেও রয়েছে শান্তিপূর্ণ কুমিরদের বসবাস। বাজুলের বিশেষত্ব অন্য জায়গায়। এখানে মানুষের সঙ্গেই রয়েছে কুমিরের বাস। দিব্যি হাত বোলানো যায় তাদের গায়ে। আর সেই টানেই জমে উঠেছে বাজুলের পর্যটনশিল্প। দড়িতে মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে গাইডরা লোভ দেখায় তাদের। গন্ধে-গন্ধে তারা উঠে আসে দিঘি থেকে। পর্যটকদের সঙ্গেও জমে ওঠে বন্ধুত্ব।

আরও পড়ুন
এককালে দু’পায়ে হেঁটে বেড়াত কুমির, নতুন গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য

তবে সাম্প্রতিককালে কিছুটা কমেছে অতিথিদের ভিড়। বুকরিনা ফাসোর রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। বাড়ছে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির দাপট। পাঁচ বছর আগেও যেখানে ১০০০০ পর্যটক আসতেন প্রত্যেক বছর, সেখানে সংখ্যাটা এখন নেমেছে চার-পাঁচ হাজারে। সঙ্গে রয়েছে বিশ্ব-উষ্ণায়নের সমস্যা। সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকার পাশাপাশি বাজুলে-তেও তীব্র হচ্ছে জলসংকট। মানুষের সঙ্গে বিপদে পড়ছে ‘বন্ধু’ কুমিররাও।

এখন এই পবিত্র কুমিরদের রক্ষা করাই বাজুলের প্রধানতম কাজ। যেখানে সারা বিশ্বে হিংসার বাড়বাড়ন্ত, সেখানে অন্য গল্পের সন্ধানে এই গ্রামের মানুষেরা। তারা যেন প্রমাণ করতে চায় যে, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় জয় করা যায় হিংস্র শক্তিদেরও। খেলার ছলে বন্ধুর মতো জড়িয়ে নেওয়া যায় তাদের। শিকার আর শিকারি বলে কিছু থাকে না পৃথিবীতে। পায়ের পাতা জলে ডুবিয়ে অনায়াসে বলা যায়, ‘কুমির তোমার জলকে নেমেছি...’

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More