বাউল-ফকিররা বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসের সঙ্গে প্রবলভাবে যুক্ত। তাঁদের জীবনযাত্রায়, গানে, সাধনায় মিশে আছে বাংলার মাটির টান। অথচ সেই মাটিতেই তাঁরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন। মুর্শিদাবাদে তাঁদের মাজার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, আখড়া উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, দাঁড়ি টানারও চেষ্টা চলছে গানে। অভিযোগ, মূলত ধর্মীয় মৌলবাদের জেরেই আক্রান্ত হচ্ছেন এঁরা, সঙ্গে প্রশ্রয় দিচ্ছে রাজনীতিও।
এই ঘটনা অবশ্য আজকের নয়। বহু বছর ধরেই নাকি এই মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাঁচতে হচ্ছে বাউল-ফকিরদের। অথচ এদের জীবনযাত্রা, এদের দর্শন কখনই একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে আশ্রয় দেয় না। যে কোনও ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে বাউল এবং ফকির হতে পারেন। জীবনের ধর্মই তাঁদের কাছে আসল। সবথেকে বড় প্রমাণ তাঁদের গানগুলি। বাউল-ফকির গানগুলি শুধুমাত্র বাংলার সম্পদ নয়, তার মধ্য দিয়েই নিজেদের নিরন্তর খোঁজের কথা বলে যেতে চেয়েছেন তাঁরা। সেখানে যেমন এসেছেন ঈশ্বর, তেমনই এসেছেন আল্লা।
এই সাধনাই এখন বিপদের মুখে পড়ছে। ইসলাম মৌলবাদের আক্রমণই বেশি হচ্ছে এই বাউল-ফকিরদের ওপর। রক্ষণশীল মুসলিমরা গান-বাজনাকে ‘হারাম’ ঘোষণা করে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করে চলেছে। একটা সময় পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশেও এরকম অত্যাচার প্রচুর হয়েছিল। মাজার ভেঙে দেওয়া, বাউল-ফকিরদের আটকে রাখা, অত্যাচার— কম হয়নি কোনকিছুই। এইসবেরই প্রতিবাদে ১৯৮৩ সালে তৈরি হয় বাউল ফকির সংঘ। কিন্তু আক্রমণ হচ্ছে, এখনও। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ঘটে গেছে মুর্শিদাবাদে। সেখানে জুলাই মাসে একটি মাজারকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া হয়। যে অল্প কয়েকজন প্রতিবাদ করেছিলেন, তা ধোপে টেকেনি। পরবর্তীতে সেই ভাঙ্গা মাজারের জায়গায় তৈরি করা হয় ঈদগাহ। তবে এই দুষ্কৃতীদের পেছনে রাজনৈতিক হাতও রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, মাজার ভাঙার ঘটনাটা প্রশাসনকে জানালেও তারা একপ্রকার নির্বিকারই থাকে। কোনরকম ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
লালন, শাহ আব্দুল করিম সহ ফকির-বাউলদের গান আমাদের সমৃদ্ধ করে রাখে। আমাদের একা থাকার সঙ্গীও হয়ে ওঠে কখনও কখনও। তাঁদের উত্তরসুরিদের আস্তানা আজ ধর্মীয় মৌলবাদের শিকারে। সেখানে কেবল থাকে ধর্মীয় গ্রন্থের হুংকার, ভাঙা দোতারার পাশে।
ছবির শিল্পী - সুশোভন অধিকারী
ঋণ - ধ্রুবপদ, বার্ষিক সংকলন, ১৯৯৭