চিরবিশ্রামে বাউল সাধক উপেন্দ্রনাথ মহন্ত, অসম্পূর্ণ থেকে গেল তাঁর সৃষ্টিগুলির লিপিবদ্ধকরণ

গানের খাতা পড়ে রইল। রয়ে গেল অলিখিত গানের কলি। মাটির সুর। এসব রেখেই চোখ বুজলেন সাধুবাবা। অতল ঘুমের সাগরে পাড়ি দিলেন বাউল সাধক উপেন্দ্রনাথ মহন্ত। বয়স হয়েছিল নব্বইয়েরও বেশি। জন্ম ১৯২৯ সালে, পুরুলিয়ার বানসা গ্রামে। শেষ বয়সেও সুস্থ-সবল, কর্মঠ এই মানুষটি এভাবেই যে চলে যাবেন, তা পরিচিত সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল একেবারে।

‘বাউল’ ও ‘সাধক’ - শুধু এই দুটো কথা উল্লেখ করলে ভুল হবে খুব। আসলে তিনি নিজেই একটি আধার। একটি সম্পূর্ণ দর্শন। একটি প্রাণোচ্ছল খরস্রোতা নদী। যার প্রতি বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে রয়েছে হাজারো গল্প। শুরু থেকেই ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন সাধুবাবা। নির্লিপ্ত সাধারণ জীবন। তবে বাঁক নিল সে নদী। সংসার, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি এসব ছেড়েই উড়িষ্যার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন তিনি। জরুন্দাগাদি ধামের শম্ভু দাস বাবাজির কাছে দীক্ষা নিলেন অদ্বৈতবাদের। নিরাকার ব্রহ্মের। অন্যদিকে তাঁর রক্তে বইছে মাটির সুর। বইছে বাংলা ভাষা। সেই টানেই আবার ফিরে এলেন পুরুলিয়ায়।

বাউল সুর, নিজের লেখা গানের কলি, পদ। এদের সঙ্গী করেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পুরুলিয়ার প্রান্তর। মুগ্ধ করেছেন শ্রোতাদের। স্বনামধন্য পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত ঝুমুরশিল্পী সলাবত মাহাতোর সঙ্গে গান করেছেন একই মঞ্চে। কখনও সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবতত্ত্ব, গুরুবাদ আবার কখনও বা নিছকই প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, জীবনের চাওয়া-পাওয়া— এসবই কখন যেন আপন খেয়ালেই প্রবেশ করেছে তাঁর গানে। মিশে গেছে অদ্ভুতভাবে। যে আধারের পরিধি এতটাই বিস্তৃত, তাকে এক লেখায় ধরতে পারাও কঠিন।

গীতিকার, সুরকারের পাশাপাশিই তিনি ছিলেন অসামান্য একজন কবি। ছিলেন কালজয়ী। কারণ তাঁর রচনার সীমানা ছিল চর্যাপদ থেকে চৈতন্যদেব পর্যন্ত বিস্তৃত। পেরিয়ে আসা সেই সময়ের গল্পকেই তিনি বাঁধলেন নতুন আঙ্গিকে, চিন্তনের অমোঘ বুননে। “ভবণই গহণগম্ভীরা বেগেঁ বাহী/ দু’আন্তে চিখিল মাঝেঁ না থাহী...”, চর্যাপদ মিশে গেল তাঁর লেখায় এভাবেই। রচনা করেছিলেন একাধিক গীতিকাব্য। নিজস্ব ভঙ্গীতে লালন করেছিলেন মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, কৃষ্ণপদাবলী। এইসব গীতিনাট্যের উপস্থাপনাও করেছিলেন তিনি। ছিলেন নৃত্যশিল্পীও। ছৌ থেকে বাঈ বা ঝুমুর। হাতের তালুর মতই চেনা ছিল প্রতিটি কলার ভঙ্গিমাই। এখনো গ্রামে গ্রামে অভিনীত হয় তাঁর লেখা গীতিনাট্যগুলি।

তবে এসবের বাইরে আরও একটা পরিচয় ছিল সাধুবাবা উপেন্দ্রনাথ মহন্তের। দক্ষ ছিলেন আয়ুর্বেদশাস্ত্রে। পুরুলিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলে তখনো পৌঁছায়নি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান। নেই বসন্তের টীকা। আয়ুর্বেদের অস্ত্র কাজে লাগিয়েই সারিয়ে তুলতেন দুরারোগ্য রোগ। 

১৯৮৯ সালে হিড়বাধ ব্লকের ধানারাঙ্গী গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন অলেখ মহিমাশ্রম। এই আশ্রমেই শেষ বয়স অবধি ছিলেন সাধক উপেন্দ্রনাথ মহন্ত। এখানেই নিভৃতে চর্চা করে গেছেন বাংলা সুর, সংস্কৃতি এবং কাব্যের। প্রতিবছর এই আশ্রমেই আয়োজন করতেন ‘বিশ্বযজ্ঞ শান্তি’ অনুষ্ঠানের। কিন্তু এই উৎসবকে আধ্যাত্মিকতার ঊর্ধ্বে সংস্কৃতির আখড়া করে তুলেছিলেন তিনি। টানা তিন দিন ধরে চলত যজ্ঞ। যজ্ঞের শুরুর দিন সারা গ্রামের মানুষের জন্য আয়োজন করা হত ভোজের। পরের দিন চলত বাউল গানের আসর। পুরুলিয়ার অন্যান্য গ্রাম, বাঁকুড়া, এমনকি উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক লোকশিল্পীই ছুটে আসতেন এই উৎসবের টানে। তারপর দিন আয়োজিত হত কীর্তন। নদীয়ার অনেক কুশীলব অংশ নিতেন অনুষ্ঠানে। শুধু নিজের সৃষ্টিসাধনা নয়, বরং অন্যান্য শিল্পীদের প্রকাশের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন তিনি এভাবেই।

তবে প্রতারণারও শিকার হয়েছিলেন। নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন অজস্র শিল্পীকে। অনেকেই তাঁর গান নিজের করেই চালিয়েছেন। এমনই একটি বিখ্যাত নাম ছায়ারানী দাস। সাধুবাবার থেকে অনেক গানই তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যোগাযোগই রাখেননি আর কোনো। এভাবেই হারিয়ে গেছে তাঁর অজস্র রচনা। সম্প্রতি তরুণ শিল্পী উজ্জ্বল গড়াই এবং প্রণবশ্রী হাজরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর রচনা, সৃষ্টিগুলি এক জায়গায় লিপিবদ্ধ করার। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন উজ্জ্বল। জেনেছেন আদ্যোপান্ত রসিক মানুষটিকে। কিছু গান শিখেছেন সাধুবাবার থেকেই। শেখার কথা ছিল আরো অনেক গানের। কিছু গান সাধুবাবা নিজের কণ্ঠেই রেকর্ড করে দিয়েছিলেন উজ্জ্বলকে। শেষের বছরগুলোয় উজ্জ্বলের তাগিদেই নিজের রচনা করা গানগুলি খাতায় নতুন করে লিখছিলেন সাধুবাবা। সেখানে পদের বিশ্লেষণ করে করে বুঝিয়েছিলেন তত্ত্বের খুঁটিনাটি। তবে লিখতে কষ্ট হত শেষ বয়সে। অনবরত জল পড়ত চোখ থেকে। প্রিয় ছাত্রের মতই উজ্জ্বল বারণ করতেন চোখের ওপর চাপ না দিতে। বলতেন, সময় নিয়ে ধীরে সেসব শেষ করার। কিন্তু সেসব শেষ হল কই? নিজের রচনার ছাপা অক্ষরে প্রকাশ পাওয়া, দেখে যাওয়া হল না আর তাঁর। তার আগেই মোহনায় ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রাণবন্ত নদীটি। সাধুবাবার কথায়, “নাবিক রূপে সাধুগুরু নৌকা বেয়ে যায়/ জীবের পারাপারের লাগি নামের তরী বায়”। কবিরা বোধহয় এমনিই হন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।  

উপেন্দ্রনাথ মহন্ত সারা জীবন নিভৃতে কাটিয়েছেন। অন্যের সৃষ্টি হিসাবে পরিচিত তাঁর গানগুলি বিচার পায়নি কোনোদিন। তাত্ত্বিক জ্ঞানের জন্য পেয়েছিলেন ‘তত্ত্বজ্ঞানী’ সরকারি তকমা। অথচ এমন একজন মানুষকে এই প্রজন্ম জানতেই পারল না। তিনি কি সামনে আসেননি? নাকি আমরাই পৌঁছাতে চাইনি তাঁর কাছে? এই দীনতা হয়তো আমাদের। তবে তাঁর অক্ষয় সৃষ্টিগুলি রয়ে গেল। উজ্জ্বল ও প্রণবদার হাত ধরেই এসব সৃষ্টি পৌঁছাবেই সকলের কাছে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই সুরের স্পর্শ পেলে, তত্ত্বের মায়ায় আটকে পড়বেই যে-কোনো পাঠক। সেই রাস্তা তৈরির গুরুদায়িত্ব এখন উজ্জ্বল আর প্রণবদার ওপর। শুধু আক্ষেপ একটাই। অসম্পূর্ণ থেকে গেল তাঁর এক-জীবন রচনার পাঠোদ্ধার। 


ঋণ : উজ্জ্বল গড়াই, প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More