উত্তর কলকাতার বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক অঞ্চল শোভাবাজার। কত চেনা অচেনা ইতিহাস ছড়িয়ে আছে এখানে। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে সেসবই এক নিমেষে ছুঁয়ে ফেলা যায়। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেল হাটখোলা পোস্ট অফিস। আরেকটু এগোলেই সামনে পড়বে একটি তিনতলা বাড়ি। এরকম কত দোতলা, তিনতলা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই বাড়িটি একটু যেন বিশেষ। চেহারাতেই সেটা বোঝা যায়। যেন এক অদ্ভুত শিল্পী এসে তৈরি করে গেছেন বাড়িটি। কত রকম নকশা, কত তার কারুকাজ! এক ঝলক দেখলে মনে হবে কোনো এক নবাবি স্থাপত্য। যারা বাড়িটার ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত, তাঁরা ঠিক ভুলটা ভাঙিয়ে দেবেন।
অবশ্য ৯২ নং শোভাবাজার স্ট্রিটের বাড়ির মালিক ছিলেন যিনি, একটা সময় তাঁর পরিচয় গোটা বাংলাতে তো বটেই; দেশ এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তৈরি করেছিলেন ইতিহাস। তাঁর পরিচয় জানতে হলে ওই বাড়ির ভেতরেই এক ঝলক তাকানো যাক। ঢোকার মুখেই বিশাল ডিসপেনসারি, আর তার ওপর বড়ো বড়ো করে লেখা ‘বটকৃষ্ণ পাল, কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট’।
কথায় বলে, বাঙালি নাকি ব্যবসা বোঝে না। এই ধরণের উক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একদম প্রথম সারিতে নাম থাকবে বটকৃষ্ণ পাল ওরফে বি কে পালের। তাঁর তৈরি করা ডিসপেনসারি ও কোম্পানি রীতিমতো ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে। তৈরি করেছিলেন নিজের সংস্থা ‘বি কে পাল অ্যান্ড কোং’। উনবিংশ-বিংশ শতকে কলকাতার সবচেয়ে বড়ো ওষুধ বিক্রির কোম্পানি।
আরও পড়ুন
সরকারের সমালোচনা, ১০২ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা রাজনীতিকের
শুরুটা কিন্তু এত ঝাঁ-চকচকে ছিল না। বলা ভালো, নিজের অসম্ভব পরিশ্রম ও তীক্ষ্ণ ব্যবসায়িক বুদ্ধি বটকৃষ্ণ পালকে মসনদে দাঁড় করিয়েছিল। শিবপুরের এক দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা তাঁর। ১২ বছর বয়সে কলকাতার শোভাবাজারে চলে আসেন তিনি। টাকা রোজগার করতে হবে; তাই মামাদের সঙ্গেই কাজ করতে লাগলেন। মশলার কাজ করছিলেন দিব্যি। সেসব ছেড়ে আফিমের দোকান খোলেন তরুণ বটকৃষ্ণ। তখনও তাঁর কৈশোরকাল যায়নি, মাত্র ১৬ বছর বয়স। আর সেই সময় ব্রিটিশ সাহেবদের কল্যাণে আফিম রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর লাভ; কিন্তু একসময় ছেড়ে দিলেন এই ব্যবসা। পাটের ব্যবসা ধরে সেটাও ছেড়ে দিলেন। মন টিকছে না কোথাও। কোথায় যাবেন বটকৃষ্ণ?
আরও পড়ুন
ভাষাভিত্তিক রাজ্য চাই, ৫৮ দিন অনশনের পর মৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামীর
আরও পড়ুন
স্বাধীনতা কী, ভারত কী, ‘বিশেষ সুবিধা’ই বা কী— একটি রাষ্ট্র-আঁটুনি ফস্কা গেরোর গপ্প
একটা সময় পর রাস্তা খুঁজে পেলেন তিনি। একটা সময় অবধি কবিরাজি ওষুধেই কাজ চলে যেত শহরের। হোমিওপ্যাথির হাতও ধরলেন বহু মানুষ। অ্যালোপ্যাথির ব্যবহার যখন বাড়তে শুরু করল, তখন সেই রাস্তাকে কাজে লাগালেন বটকৃষ্ণ পাল। তৈরি করলেন নিজের আরেকটি কোম্পানি ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোম্পানি’। এবার মন বসল। বিদেশি সমস্ত ওষুধের কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের ওষুধ এনে রাখলেন দোকানে। সেই সঙ্গে নিজেরাও ওষুধ বানানো শুরু করলেন। বাড়ির নিচেই ডিসপেনসারি, সঙ্গে নিজস্ব ল্যাব— দেশীয় ফর্মুলায় নতুন নতুন ওষুধও আনতে লাগলেন তিনি। এখান থেকেই যাত্রা শুরু হল অ্যান্টি ম্যালেরিয়া ওষুধ ‘এডওয়ার্ড টনিক’-এর। বটকৃষ্ণ পালের ফার্মেসির সবথেকে বড়ো পরিচয় যে ওষুধের মাধ্যমে। আজও যার চাহিদা তুঙ্গে।
আরও পড়ুন
ভাষাভিত্তিক রাজ্য চাই, ৫৮ দিন অনশনের পর মৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামীর
আর ফিরে তাকাতে হয়নি। গোটা ব্যবসার জগত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন বটকৃষ্ণ পাল। যেন নিজেই ঘোষণা করলেন বিপ্লবের। বাংলা, ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও চলে গেল তাঁর ওষুধ। বিক্রি বাট্টায় বিশ্বের তাবড় ফার্মেসি কোম্পানিকে একসময় ছাপিয়ে গিয়েছিল বি কে পাল অ্যান্ড কোং। একপ্রকার বিশ্বজয়ই বটে! তবে ওষুধ বিক্রিতেই বটকৃষ্ণ পালের গপ্পো শেষ হয়ে যায় না।
দেশের মানুষ থেকে সাহেব— সবার বিশ্বাসযোগ্য মানুষ হয়ে উঠেছিলেন বটকৃষ্ণ। যেমন দুহাতে টাকা করেছেন, তেমনই দানও করেছেন অকাতরে। নিজের ‘এডওয়ার্ড টনিক’ গরীবদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়েও দিয়েছেন। তৈরি করেছেন স্কুল। তবে বটকৃষ্ণ’র আরও একটা পরিচয় আড়ালে রাখলে অন্যায় হবে। সেটা তাঁর বিপ্লবী সত্তা। নিজের ব্যবসা দিয়ে এমনিতেই বিপ্লব তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ভারতের পরাধীন অবস্থা সহ্য করতে পারতেন না। নিজেও সরাসরি সংগ্রামে নামতে পারতেন না। কারণ সাহেবদের কাছে তাঁর সুখ্যাতি, এবং ব্যবসা। তা সত্ত্বেও সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে গোপনে কাজ চলতে লাগল। এমনিতেই শোভাবাজারের বাড়ির ডিসপেনসারি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। রাত বিরেতেও কেউ যাতে খালি হাতে ফিরে না যান, সেই খেয়াল রাখা হয় সবসময়।
এরই মধ্যে মুখ ঢেকে কয়েকজন লোকও আসত। বটকৃষ্ণ পাল নিজের হাতে ‘ওষুধ’ তুলে দিতেন ওদের হাতে। ওই মুখ ঢাকা লোকগুলোর আসল পরিচয় অন্য। তাঁরা বিপ্লবী। আর বটকৃষ্ণ যে জিনিসগুলো এগিয়ে দিচ্ছেন, সেগুলো ওষুধ নয়। তার কোনোটায় আছে নাইট্রিক অ্যাসিড, কোনোটায় পটাশ। বোমা বানানোর সরঞ্জাম! যেহেতু তাঁর নিজের রসায়নাগার ছিল, তাই এইসব জিনিস জোগাড় করা সুবিধা ছিল। আর বটকৃষ্ণ পাল তখন সাহেবদের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। সে এমন করতে পারে, এটা ধারণাই ছিল না। তাই কোনো সন্দেহই আসেনি বটকৃষ্ণের ওপর। এমনকি, তাঁর কাছের লোকেরাও এই বৈপ্লবিক কাজ সম্পর্কে কিচ্ছু জানতেন না! নিজের খ্যাতিকে ব্যবহার করেছিলেন মজবুত ঢাল হিসেবে; আর তার পেছনে চলত স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রস্তুতি।
শোভাবাজারের সেই ঐতিহাসিক বাড়িটির সামনে দাঁড়ালে গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। এখানেই রাতের অন্ধকারে বিপ্লবীদের দিকে বটকৃষ্ণ পাল এগিয়ে দিচ্ছেন বোমা তৈরির মশলা। পরক্ষণেই নিজের ওষুধ নিয়ে চলে যাচ্ছেন গরীব মানুষদের মধ্যে। কখনও চলে যাচ্ছেন সাহেবদের অন্দরে। বটকৃষ্ণ পাল এভাবেই নিজেকে মেলে ধরেছিলেন অন্য উচ্চতায়। যাকে ছোঁয়ার সাহস বা স্পর্ধা কারোর ছিল না…
Powered by Froala Editor