প্রথম জীবনে ছিলেন গ্রন্থাগারিক, সংবাদপত্রে ব্যঙ্গচিত্রও এঁকেছেন বাসু চট্টোপাধ্যায়

গানের কথায় মিশে আছে শ্রাবণের বৃষ্টির ছন্দ, সুরে ভরপুর রোমান্টিসিজম। লতা মঙ্গেশকরের তীক্ষ্ণ কণ্ঠের সঙ্গে মানানসই গানের মেজাজ। বাণিজ্যিক ছবিতে এই ধরনের গানের দৃশ্যায়ণে সাধারণত আমরা দেখেছি সবুজ প্রকৃতির বহুল ব্যবহার, নায়কের থেকে হয়তো অনেক বেশি ফোকাসে থাকছেন নায়িকা। তাঁর জমকালো পোশাক, আবেদনময় মুখভঙ্গি, শরীরী নৃত্যের অমোঘ আকর্ষণ। সেই চিরচেনা ট্রেন্ড ভাঙল সত্তরের দশকের শেষের দিকে। অপার সৌন্দর্যের প্রকৃতি ছেড়ে প্রেমের জায়গা বদলাচ্ছে ধূসর ধোঁয়ার নাগরিকতায়। প্রেমিকার মুখের ক্লোজ-আপের বদলে ব্যবহার হচ্ছে লং শট এক্সপোজার। জলমগ্ন রাস্তায় জল ছেটাতে ছেটাতে দৌড়চ্ছেন দুজনেই। মানুষী চরিত্রের চেয়ে বড় বেশি চোখ টানছে পটভূমিকা। একটি আগাপাশতলা শহরের ইতিবৃত্ত। লালরঙা ডবল ডেকার বাস, বোল্ডারে আছড়ে পড়া সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, কুয়াশা-ঘেরা জাহাজের দৃশ্যমানতা।

কিছু ছবি তৈরি হয়েছিল সেসময়। মানে ওই সত্তর-আশির দশকে। সেখানে গল্পের নায়ক-নায়িকা আর পার্শ্বচরিত্রদের পাশে আলাদা করে আরও একটা চরিত্রের প্রবল উপস্থিতি অনুভূত হত ছবির ফ্রেমে ফ্রেমে। সে চরিত্রের নাম বোম্বে। পিচঢালা ব্যস্ত রাস্তা, কখনও তা গাছে ছাওয়া, পার্ক, সমুদ্রের ধার, ঠা-ঠা রোদের তাপ, হলুদ-কালো অটো। প্রেমিক-প্রেমিকার বিলাসিতা বলতে আরব সমুদ্রের লাগোয়া সৈকতে দাঁড়িয়ে একটাই ডাবের গুহা-রহস্যে ডোবানো দুটো স্ট্র পাইপ, দুই উষ্ণ মুখের কাছাকাছিও বলতে ওইটুকুই। একটু বেশি বেতনের চাকরি হলে ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁ কিংবা ক্যাফে, কিন্তু সেখানেও উর্ধ্বসীমা বলতে কফি। গানের ব্যবহার ছিল, তা কিন্তু দৃশ্যপট বা লোকেশনের মেজাজের সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। পোশাক-পছন্দেও চেনা, সহজ অথচ সুচিন্তক এক নির্দেশনার ছাপ। প্রেমিক সেখানে একটা ফুলহাতা জামা আর বেল বটম প্যান্টেই দিব্যি হেঁটে আসছে রাস্তা দিয়ে, পাশে আটপৌরে হাল্কা রঙের শাড়িতে প্রেমিকা। মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, রোজনামচার টানাপোড়েনের সফল চিত্রায়ণের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাংলায় সেসময় করছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় বা তরুণ মজুমদাররা, একই সময়ে বোম্বেতে সেই কাজ শুরু করেছিলেন হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, বাসু ভট্টাচার্য এবং বাসু চট্টোপাধ্যায়।

অন-লোকেশন শুটিং, অ্যামেচার কলাকুশলীর ব্যবহার, সেইসঙ্গে চারপাশের দেখা জীবনকে পর্দায় চিত্রায়ণের যে ধারা শুরু হয়েছিল ইতালিয়ান নিও-রিয়্যালিজমের হাত ধরে, ভারতীয় চলচ্চিত্রে সেই বাস্তববাদের সার্থক প্রয়োগ আমরা দেখেছিলাম ঋত্বিককুমার ঘটকের ‘নাগরিক’ বা বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ এবং অবশ্যই এই ঘরানার দ্বারা সরাসরি অনুপ্রাণিত সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-তে (উল্লেখ্য, সত্যজিতের মতোই ভিত্তোরিও দি সিচার ‘বাইসাইকেল থিভস’ দেখে বিমল রায়ও ‘দো বিঘা জমিন’-এর নির্মাণশৈলী নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন)। যদিও তার আগেই ১৯৪৬ সালে মুক্তি পেয়ে গেছে চেতন আনন্দের ‘নিচা নগর’, যা কিনা আজ পর্যন্ত কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডা’ওর (সেরা ছবির পুরস্কার) পাওয়া একমাত্র ভারতীয় ছবি। সেই অর্থে ভারতীয় চলচ্চিত্রে সামাজিক বাস্তববাদের ধারা শুরু করেছিল সেই সময় থেকেই। বলা যায়, তাকে একটি আলাদা মানে উন্নীত করে তুলতে পেরেছিলেন কলকাতায় সত্যজিৎ-ঋত্বিকরা এবং বোম্বেতে বিমল রায়, পরে তাঁরই ঘরানার যোগ্য উত্তরসূরি হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়রা। লোকেশনের যে চমৎকার ডিটেলিংয়ের কথা বললাম শুরুতেই, সেই চিত্রশৈলী এই বাস্তববাদ প্রদর্শনেরই সময়ানুগ রূপ।

ভারতীয় সমান্তরাল চলচ্চিত্রের আলোচনায় দক্ষিণ কলকাতার যে ক্যাফের কথা বারবার উঠে আসে, পঞ্চাশের দশকের শুরুতে সেই প্যারাডাইস ক্যাফেতে যাঁরা নিয়মিত আড্ডা মারতে বসতেন, তাঁদের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসত আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পোদেমকিন’, পুদভকিনের ‘মাদার’ এবং অবশ্যই ইতালিয়ান নিও-রিয়্যালিস্ট ছবিগুলির বিশ্লেষণ। ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তাপস সেন, সলিল চৌধুরী, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, বংশী চন্দ্রগুপ্তদের সঙ্গে সেখানে যোগ দিতেন হৃষিকেশও। তাই ঋত্বিক-মৃণালের কাল্ট ছবিগুলির সঙ্গে বোম্বের পরিবেশে হৃষিকেশ বা দুই বাসুর বানানো ছবিগুলির ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রকে জীবনের অংশ হিসেবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে যেন কোথাও একটা যোগসূত্র থেকে যায়। শুধু সেখানে বাড়তি হিসেবে যোগ হয়েছে নির্মল হাস্যরসের উপাদান আর মধ্যবিত্তের ছাপোষা আড়ম্বড়হীনতা। তা যেন খানিক সংযমী। বনেদিয়ানার চাকচিক্য বা শ্রমজীবী শ্রেণির রূঢ় বাস্তবের কাঠিন্য সেখানে নেই।

আরও পড়ুন
প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়, রেখে গেলেন অসংখ্য কালজয়ী সিনেমা

এঁদের মধ্যে বাসু চট্টোপাধ্যায়ের জার্নিটা অবশ্য একদমই অন্যরকম। আজমীরে জন্ম। বাবা ছিলেন রেলওয়ের কর্মী। পড়াশোনা মথুরা ও আগ্রায়। এই দুটি জায়গায় পড়াকালীনই চলচ্চিত্রের প্রতি গড়ে ওঠা টান। তারপর ১৯৪৮ সালে স্নাতক হওয়ার পর চলে এসেছিলেন বোম্বেতে। প্রথমে অল্প কিছুদিন ছিলেন একটি আর্মি-পরিচালিত স্কুলে গ্রন্থাগারের দায়িত্বে। তারপর যোগ দিয়েছিলেন রুশি করঞ্জিয়া প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ‘ব্লিৎজে’। এটি ছিল ভারতের প্রথম সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড। ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ধারার শুরুও এই ট্যাবলয়েডের হাত ধরেই। আর. কে. লক্ষ্মণ, আবু আব্রাহামের মতো কিংবদন্তি কার্টুনিস্টদের আঁকা শুরু হয়েছিল এই কাগজে। বাসু চট্টোপাধ্যায়ও যোগ দিয়েছিলেন রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রকর হিসেবে। পরবর্তীকালে তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলি যেমন ‘ছোটি সি বাত’ বা ‘চিতচোরে’ যে ধরনের বোধদীপ্ত হাস্যরসের দেখা মেলে, সেখানে আসলে এই সহজাত ব্যঙ্গ-ভঙ্গিমারই সার্থক প্রকাশ।

আরও পড়ুন
বাঙালি পরিচালকের হিন্দি সিনেমা, ফ্লাইট অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় মান্টো-র

স্বাধীনতার পর থেকে ফিল্ম সোসাইটি নির্মাণের ধারাবাহিকতা শুরু হল। তাঁর সমসাময়িকদের মতো বাসুও জড়িয়ে পড়েছিলেন সেই ধারার সঙ্গে। তারপর ১৯৬৬ সালে তাঁরই সমনামের আরও একজন পরিচালকের ছবিতে সহকারীর কাজ দিয়ে চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যে যোগসূত্র তৈরি হল, তা চলবে প্রায় চার দশক। তাঁর ছবিতে ইনডোরের সেট কিংবা আউটডোরে যে ধরনের আলোর ব্যবহার দেখা যায়, তাতে মিশে আছে সারল্য। রঙের ব্যবহারে আছে স্বাভাবিকত্ব। এডিটিংয়ের মুন্সিয়ানা সেখানে আছে, কিন্তু কোথাও আমাদের খুব বেশি তা ভাবায়নি। কিন্তু যা আমাদের খুব বেশি চোখে পড়েছে, অথচ, তাকে আলাদা করে লক্ষ করার প্রয়োজন বোধ হয়নি, তা হল শিল্প নির্দেশনা। সাধারণ বাড়ির ড্রয়িংরুমের ছিমছাম সজ্জা চোখ টানার মতো বিষয় বটে। নব্বইয়ের দশকে যে টেলিভিশন সিরিয়াল তাঁকে আপামর বাঙালির ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দিয়েছিল, সেই ‘ব্যোমকেশ বক্সী’তেও ঘরোয়া, সাদাসিধে জীবনকেই তুলে এনে বাজিমাত করেছিলেন। দর্শকের বিনোদনের কথা সম্পূর্ণ মাথায় রেখেও যে এমন জীবনের কাছাকাছি ছবি বানানো যায়, তা বাসু চট্টোপাধ্যায়রাই দেখিয়েছিলেন। 

আরও পড়ুন
স্ত্রী বাঙালি, কাজ করেছেন বাঙালি পরিচালকদের সঙ্গেও; হয়ে উঠেছিলেন বাংলার আপনজন

ছবির বাইরের জীবনেও আটপৌরে ভাবনায় বেঁচেছিলেন তিনি। তথাকথিত এলিট শ্রেণির পরিচালক হিসেবে তাঁকে গণ্য করবেন না চলচ্চিত্র-বোদ্ধারা, কিন্তু ভিলেন-পেটানোর হিংস্র হিরোগিরির লার্জার-দ্যান-লাইফ ভাবনা দেখতে দেখতে ক্লান্ত ছাপোষা দর্শককে তিনি যে একবুক ঠাণ্ডা বাতাসের সন্ধান দিয়েছিলেন, সেকথা অস্বীকার করি কীকরে! ছবি বানানো বন্ধ করে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সোজাসাপ্টা বলতেন, তিনি ছবি বন্ধ করতে চাননি, বরং প্রযোজকরাই তাঁর কাছে অফার নিয়ে আসা বন্ধ করেছিল। নিজের ভাবনা ও কাজের প্রতি এমন সততা, ‘মানুষের পরিচালক’ হিসেবে আলাদা জায়গাটা যে অনেকদিনই করে নিয়েছেন বাসু চট্টোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন
চলে গেলেন ‘টম এন্ড জেরি’, ‘পপাই দ্য সেলার’-এর পরিচালক জিন ডায়েচ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
এই প্রথম মহাকাশে পাড়ি বাংলা চলচ্চিত্রের, মঙ্গলের মাটিতে রহস্য বুনলেন পরিচালক

More From Author See More