মঞ্চে উপস্থিত দুই বরিষ্ঠ অভিনেতা। তাঁরা দুজনেই একসময় ‘ফেলুদা’ চরিত্রটির জন্য দৌড়ে ছিলেন। অন্তত সেভাবেই পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘ওম বুকস ইন্টারন্যাশনাল’-এর কর্ণধার শান্তনু রায়চৌধুরী। তাঁরা আর কেউ নন, অভিনেতা বরুণ চন্দ (Barun Chanda) এবং ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতার সাউথ সিটি মলের বই বাজার ‘স্টারমার্ক’-এ গতকাল সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন তাঁরা। সেই সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক সৃজিত মুখার্জি। প্রায় ২ ঘণ্টার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার গুরুদায়িত্ব পালন করে গেলেন বরুণ চন্দের পুত্র অভীক চন্দ। উপলক্ষ্য, সত্যজিৎ রায়ের জীবনের নানা অজানা কাহিনি নিয়ে বরুণ চন্দের লেখা বই প্রকাশ। ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ (The Man Who Knew Too Much) – বইয়ের শিরোনামে এভাবেই সত্যজিৎ রায়কে ধরতে চেয়েছেন তিনি।
কথায় কথায় উঠে এল এই বই লেখার নেপথ্য কাহিনিও। বিগত এক বছর ধরে সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবর্ষকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন, এবং তার মধ্যেই কোভিড পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি জীবন – এর মধ্যে বারবার পুরনো দিনের স্মৃতিতে ফিরে গিয়েছেন বরুণবাবু। আর সেই স্মৃতিমেদুরতা থেকেই জন্ম নিয়েছে এই বই। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ অবশ্য সিনেমার সূত্রে নয়। একটি বিজ্ঞাপনের কাজের সূত্রে তিনি গিয়েছিলেন রায়বাবুর সাক্ষাৎকার নিতে। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্রথম দিনের যাবতীয় কাজ যে ব্যর্থ হয়, সে-কথাও জানালেন বরুণবাবু। তবে এই আলাপের সূত্র ধরেই জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সামনে এসে দাঁড়ান তিনি।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সত্যজিৎ-জাদুতে আবারও মুগ্ধ আন্তর্জাতিক দর্শক
আরও পড়ুন
‘অপরাজিত’ সত্যজিৎ ও বাংলা চলচ্চিত্রের পদাবলী
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সোমবারের দুপুর, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও সত্যজিৎ-ছায়া
পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বরুণবাবু বলেন, “আমাকে হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুমি বাংলা পত্রিকা পড়ো?” তাঁর উচ্চারণে ইংরেজি ভাষার প্রভাবের কারণেই হয়তো সত্যজিৎ রায় এমন প্রশ্ন করেছিলেন, মন্তব্য করলেন সৃজিত মুখার্জি। সেদিন সত্যজিৎ রায় বরুণবাবুকে বলেছিলেন, শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি উপন্যাস পড়ে রাখতে। তার মধ্যে একটি শঙ্করের লেখা ‘সীমাবদ্ধ’। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল সেই উপন্যাস থেকে সিনেমা তৈরির কাজ। আর সকলেই জানেন, সেই সিনেমায় শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে প্রথম দেখা গেল বরুণ চন্দকে। ‘সীমাবদ্ধ’ ছাড়াও অন্য যে উপন্যাসটি পড়তে বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়, সেটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘কালো রাস্তা সাদা বাড়ি’। তবে এই উপন্যাসটি নিয়ে আর সিনেমা তৈরি করা হয়ে ওঠেনি।
বইয়ের প্রকাশক হিসাবে এমনই অজস্র স্মৃতির সঙ্গে আগেই পরিচিত হয়েছেন শান্তনু রায়চৌধুরী। আলোচনায় বারবার তার আভাসও দিয়েছেন। যদিও পাঠকের কাছে বইটি নিয়ে উত্তেজনা অক্ষুণ্ণ রাখতে কোনো ঘটনার কথাই স্পষ্ট করেননি। তেমনই কথা প্রসঙ্গে উঠে এল ফেলুদা চরিত্রের চিত্রায়ণ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ভাবনার কথা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি তাঁর মাথায় ছিল বরুণ চন্দ এবং ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের নামও। শেষ পর্যন্ত সেই চরিত্রটি না পাওয়ায় বরুণবাবু যে যথেষ্ট আহত হয়েছিলেন, তাও স্বীকার করলেন। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানতেন না তাঁর এই পরিকল্পনার কথা। তাই তিনি সহাস্যে জানান, “আমি কোনোদিনই কোনো চরিত্রের দৌড়ে ছিলাম না। যতক্ষণ না আমাকে কোনো চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে, আমি কোনো দৌড়ে থাকিনি।”
এই আলোচনায় অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই খুব কম অংশ নিয়েছেন সৃজিত মুখার্জি। কারণ তাঁর কাছে সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি বলতে শুধুই তাঁর সিনেমাগুলি দেখার অভিজ্ঞতা। তবে উত্তর প্রজন্মের সমস্ত পরিচালকের মতোই তাঁর সিনেমা ভাবনার জগৎ জুড়েও যে সত্যজিৎ রায় ছড়িয়ে রয়েছেন, সে-কথা জানালেন তিনি। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘অটোগ্রাফ’ বানাতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতেই। বরুণ চন্দ এবং ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক আসনে বসে তিনি সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে আরও নানা কথা জেনে নিতে চাইছিলেন। চিনতে চাইছিলেন মানুষ সত্যজিৎ রায়কেও।
বরুণ চন্দের কথাতেও বারবার পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ফিরে ফিরে এসেছেন মানুষ সত্যজিৎ রায়। বিশপ লেফ্রয় রোড থেকে স্টুডিওতে যাওয়ার পথে যিনি বরুণবাবুর ভবাণীপুরের বাড়ি থেকে তাঁকে গাড়িতে তুলে নিতেন। তারপর যেতে যেতে নানা ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে কথা বলে যেতেন অনবরত। বরুণবাবু আলু সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়ে যাচ্ছেন শুনে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনিও আলু সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেতে ভালোবাসেন। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও তাঁর এই মানবিক অনুভূতির কথা শুনে সমস্ত দর্শকের মধ্যেই একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
অনুষ্ঠানের শেষে দর্শকাসন থেকে উঠে আসে নানারকম প্রশ্ন। স্বাভাবিকভাবেই ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের মতো দাপুটে অভিনেত্রীর সঙ্গে বরুণ চন্দের রসায়নের প্রসঙ্গ ওঠে। তেমনই বরুণ চন্দের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বিজ্ঞাপন জগতে কাজের অভিজ্ঞতা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় কতটা প্রভাব ফেলেছিল। উত্তরে বরুণবাবুর নিজের অভিজ্ঞতাও মিশে যায়। কারণ এই একই অভিজ্ঞতা যে তাঁর নিজেরও তৈরি হয়েছিল।
ঘণ্টা দুয়েকের আলোচনায় এভাবেই উঠে এলেন এক অচেনা সত্যজিৎ। বরুণবাবুর লেখা বইটির অবশ্য সামান্য আভাসটুকুই পাওয়া গেল শুধু। তবে সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষকে তো কেবলমাত্র একটি বইতে সামগ্রিকভাবে ধরা সম্ভব নয়। সৃজিত মুখার্জির কথায়, “তিনি তো আস্ত একটি লাইব্রেরি।” সেই লাইব্রেরিতে নবতম সংযোজন বরুণ চন্দের ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’। বইয়ের পাতায় পাতায় পাঠক যে সত্যজিৎ রায়ের জীবনের নানা অনালোচিত বা স্বল্প আলোচিত ঘটনার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হতে পারবেন, সে-কথা বলাই যায়।
Powered by Froala Editor