‘দাদা, একটা চা’ – সক্কাল-সক্কাল অর্ডার দোকানে। তারপর কাচের বয়াম থেকে পাতলা তেলতেলে কাগজে মোড়া একটা কেক বের করে নিয়ে সকালটা শুরু করেন অনেকেই। বাঙালির খাদ্যতালিকায় অনেকদিনের অতিথি ইনি, বাপুজি কেক। শুধু বড়োবেলাই নয়, ছেলেবেলায় ফিরে তাকালে আজও টিফিন বক্স খুলে অনেকেই দেখতে পাবেন, দিব্যি জাঁকিয়ে বসে আছেন ইনি। ছেলেবেলার নস্টালজিয়া থেকে পথচলতি খুচরো খিদে - প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে বাপুজি কেক অনেক নামী কোম্পানিকে কুপোকাত করে এখনও বাজার মাতাচ্ছে। মাত্র ৬ টাকাতেই। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন বাজারে প্রায় ৫০,০০০ বাপুজি কেক বিক্রি হয়। আজও তাই বড়োদিনের কিংবা জন্মদিনের বিদেশি কেক আর প্যাস্ট্রির মাঝে বাপুজি কেক বাঙালির বহু স্মৃতি উসকে দেয়।
বাপুজির পথ চলা শুরু হাওড়ার জানা পরিবারের হাত ধরে ১৯৭৩ সালে। আলোকেশ জানা প্রথম ‘নিউ হওড়া বেকারি প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে বাপুজি কেক সংস্থার রেজিস্ট্রেশন করেন। শুরুতে হাওড়ার পল্লবপুকুর অঞ্চলে ইউনিট খোলেন তিনি। পাশাপাশি কলকাতার লেকটাউনে এবং হুগলির শ্রীরামপুরে কারখানা চালু হয়। বাঙালির টিফিনে রাজকীয় হালে বসবাস শুরু করে এই কেকটি।
বাপুজি কেক মূলত বিশেষ ধরনের ফ্রুট কেক। বিভিন্ন ফলের স্বাদের কেক তৈরি করে এই সংস্থা। শুধু টাটকা ফলের স্বাদ আর গন্ধই যে বাপুজিকে জনপ্রিয়তা দিয়েছে এমনটা নয়, মধ্যবিত্ত বাঙালির পকেটের বন্ধু এই কেকটি। চায়ের সাথে বাপুজি কেকের কোলাজ কিংবা একটি কেকে সবান্ধবে কামড় বসানো, উদর আর রসনার পাশাপাশি তাই মনেরও তৃপ্তি করে।
পরবর্তী কালে জনপ্রিয়তা বাড়াতে এবং ব্যবসার খাতিরে কোম্পানি বাপুজি কেকের পাশাপাশি বিভিন্ন বিস্কুট ও পাউরুটির প্রোডাকশনের কথাও ভেবেছে। সেই থেকেই বাজারে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট এবং পাউরুটিও বাপুজির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে।
এই সংস্থার বর্তমান কর্ণধার অলোকেশ জানার দুই ছেলে অমিতাভ জানা এবং অনিমেষ জানা। বেকারিতে মেশিনের ব্যবহার আছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনও এই কেক প্রস্তুতি সম্পূর্ণভাবে হাতে করা হয়। মাঝে নোট বাতিলের সময় বেশ কিছুদিনের জন্য বাজার থেকে হারিয়ে যায় বাঙালির প্রিয় বাপুজি। মাত্র কটা দিনেই ক্রেতাদের চাহিদা বাপুজির জনপ্রিয়তা চিনিয়ে দিয়েছিল। বাজারে একাধিক কোম্পানি বাপুজি নাম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে টিফিন কেকের ব্যবসা শুরু করেছে। আর এভাবেই বাঙালির ব্যবহারিক প্রয়োগে টিফিন কেক বলতে বাপুজি শব্দটি অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে।
বর্তমানে রংচঙে নামী কোম্পানির প্যাকেটের পাশে বাপুজি কেকের একঘেয়ে সেই পুরনো কাগজের মোড়ক, ক্রেতাদের নজর কাড়তে পারে না ঠিকই, কিন্তু দূষণ আটকাতে অবশ্যই পারে। পরিবেশ-বান্ধব এই ব্যবস্থার অভিনবত্ব সেখানেই। সারা দেশ বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে, আর তার এত বছর আগে থেকেই এই কেক কোম্পানি চোখে আঙুল দিয়ে বিরোধিতা করে চলেছে প্লাস্টিক ব্যবহারের।
আরও পড়ুন
ঘরবন্দি দিনগুলোয় ফিরছে নস্টালজিয়া, আজ থেকে দূরদর্শনে ‘রামায়ণ’
বাঙালির জীবনে চলতে ফিরতে কেক খাওয়ার অভ্যেস চিরকালীন। তবে শৌখিন, সুস্বাদু, উপাদেয় কেকের চেয়ে পিওর দিশি প্রলেতারিয়েত বাপুজি কেকের স্মৃতি আর স্বাদ যে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে লেপটে আছে, একথা স্বীকার করতেই হয়।
Powered by Froala Editor