বাঁশবাগানের মাথার ওপর

আমাদের সকলেরই একটি ব্যক্তিগত আখ্যান থাকে। সেই মায়াকাব্যে লাট্টু-লেত্তি বা গুলতি, পুতুল, টায়ারের বল বা মার্বেলের মতো নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যবান অনেকেরই থাকে নিজস্ব এক নদী। হয়তো কোনো এক অদ্ভুত আদুরে ডাকনাম তার। শীর্ণ বালুচরা হলেও, তাকে নিয়ে অহংকারের শেষ নেই। সেই নদীকে বুকে নিয়েই তার বড়ো হওয়া, দামাল স্বপ্নের সাঁতার কেটে যাওয়া সেই বাল্য অনেকের কাছেই আশ্বিনের মেঘের মতো। কারও বা থাকে একটা ছোট্ট পাহাড়। টিলার চেয়ে সামান্য উঁচু সেই পাহাড়ের জ্যোৎস্নায় অভিমানে মুখ গোঁজা কোনও কিশোরী হয়তো দূরাগত বাঁশির সুরে মন রেখেছিল। পাহাড়ের শান্ত ছায়াপথ সে কথা জানে। কলকাতা-ঘেঁষা আমার মফস্বল-সম গভর্নমেন্ট কলোনিতে এসব থাকার কথা নয়। ছিলও না। এমনকি, কপাল করে খড়ের ছাওয়া বা মাটির ঘরের কণাটুকুও দেখিনি কোনোদিন কোনো পড়শির উঠোনে। পাড়াতুতো প্রাইমারি স্কুল আর বাড়ির শাসনের মাঝে একটা লম্বা ড্যাশের মতো নিঃশ্বাস নেওয়ার একটাই জায়গা... বলার মতো, আস্ত একটা বাঁশবাগান ছিল আমার।

নামেই বাগান, ঝোপঝাড়, শুকনো ঝরাপাতা আর ইতস্তত ছড়ানো বাঁশগাছের বিন্যাস। যেন ওদেরও বেড়ে ওঠা আমারই সঙ্গে। খর রৌদ্রবেলার গা জুড়োনো বাতাস, মেঘলাদিনের আলোসবুজ রং বা হিমরাতের গা-ছমছমে অন্ধকার – প্রায় দু-আড়াই বিঘে জমি নিয়ে সেই তেপান্তরের সীমানা এসে ছুঁয়ে নিত আমাদের বাড়ির উঠোন। পাঁচিলের কোনো বালাই তো ছিল না, বাবাকে কখনও দেখতাম বাঁশবাগান থেকে ছোটো বাঁশ নিয়ে এসে ফালি করে বেড়া দিচ্ছেন। বাঁশের ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে অনেকটা করেই বিস্তৃত জায়গা ছিল। সেখানে আমরা যখন তখন টায়ারের বল নিয়ে সুরজিৎ সেনগুপ্ত বা মজিদ বাসকার হওয়ার দৌড়ে মেতে উঠতাম। কখনো গুলতি হাতে ওপর দিকে চেয়ে ঘুরে বেড়াতাম একা। গুলতির সেই মাটি দিয়ে গোল্লা পাকানো গুলি কোনোদিন একটা কাক বা টিয়ার গায়ে হাওয়াও লাগাতে পারেনি। ঝরে পড়া শুকনো পাতা পায়ে পায়ে সরে গিয়ে কোনাকুনি যে পথ ঠান্ডা শরীরে সরীসৃপের মতো বিছিয়ে ছিল, সে পথ দিয়ে আমার মা যাওয়া-আসা করত মাসির বাড়ি। 

বাড়ি বলতে আসলে ঠিক অপরপ্রান্তেরই একটা ছাউনি দেওয়া হেলে পড়া বেড়ার ঘর। আমার মেসোমশাই ছিলেন চির-বাউণ্ডুলে মানুষ। তাঁর সেই তৈলাক্ত কালো চেহারায় পানের ছোপ পড়া দাঁত বার করা হাসিমুখ স্বচক্ষে বোধ হয় একবার কি দুবারই দেখেছি। মাসি লোকের বাড়ি রান্না করে ওই সামান্য ঘরটুকুর আশ্রয়ে দুই ছেলেকে মানুষ করার দুঃসহ চেষ্টা চালাতেন। ছোটোটি, মানে লালু ছিল আমার চেয়ে কিছু বড়ো। আমাদের বাড়িতেই থাকা-খাওয়া করত। পড়াশোনা তার হওয়ার ছিল না, তবুও আমার বাবার শাসনে মাধ্যমিক ডিঙিয়েছিল। আর বড়ো ছেলে বাবু থাকত তার মায়ের কাছেই। গোঁফ গজানোর বয়সে মিনিবাসের হেল্পারি করতে ঢুকে যায় আর রাতে নেশা-ভাং করে এসে মাকে পেটানোই রুটিন ছিল তার। বাঁশবাগানের এক কোণায় পড়ে থাকা আমার মাসির সেই টালির চালের ঘরটিও বলা যায় তার নিজের ছিল না। ওই খণ্ড জমিটুকু ছিল আমার জ্যাঠামশায়ের, তাঁরা থাকতেন আসামে। বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয়েই, কিছুটা দায়ে পড়েই মাসিকে ওখানে ঘর বানিয়ে থাকার অনুমতি দেন। মাঝখানে আমার বাবা থাকাটা মাসির একটা ভরসার জায়গা ছিল। মা মাঝেমাঝেই তাঁর বোনের জন্য বিশেষ কোনো রান্নার পদ পৌঁছে দিতে বা খোঁজ খবর রাখতে যেতেন। গোটা পাড়ার একপ্রান্তে একটি বিচ্ছিন্ন জংলা-আগাছাময় প্রান্তর পাড়ার লোকের কাছে অপ্রয়োজনীয় আর আস্তাকুঁড়ের মতো ব্যবহার্য হলেও অন্তত একটি পরিবারের কাছে তা জরুরি ভূখণ্ড হিসেবে শেষ আশ্রয়স্থল ছিল।

চোত-বোশেখের সন্ধ্যাগুলো যখন ঝুপ করে লাফিয়ে পাঁচিল টপকানোর মতো নেমে আসত, ঘরে ঢুকতাম খেলে-টেলে এসে। রেডিওতে তখন গান বাজছে বিবিধ ভারতীর অনুষ্ঠানে। দিদিরা চুল আঁচড়াচ্ছে, বেণী বাঁধছে। একটু পরেই বাবা ফিরবেন অফিস থেকে। কলতলায় গা ধুয়ে এসে লাল বারান্দায় ইজি-চেয়ারে বসে আয়েশ করে বসবেন। অবধারিত লোডশেডিং হবে আর আমি হারিকেন ঘিরে পড়তে বসব বাবার পায়ের কাছে। একটু আগেই বেজে ওঠা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বারবার মনে পড়বে উঠোনঘেঁষা কামিনীফুলের থইথই গন্ধে ভেসে গিয়ে। আচ্ছা, উনি কি এই বাঁশবাগানের কথা জানেন? নাহলে, এমন করে গেয়ে ওঠেন যেন আমার মতোই উনি ঘুরে বেড়িয়েছেন এখানে! মাগো আমার শোলোক বলা কাজলাদিদি কই... কে এই কাজলাদিদি? এসব প্রশ্নে ঘুরপাক খেতে খেতে বাঁশবাগানের থেকে ভেসে আসবে হাওয়া। বাবার হাতের দোল খাওয়া তালপাতার হাতপাখাতেও ঘোর লাগাবে তখন সেই বাতাসিয়া ঝোঁক।

আরও পড়ুন
যে লেখা লিখব বলে ভাবিনি কখনও

তবে বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠুক না উঠুক, ওই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বাঁশবাগান থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক শুনলে ভেতরটা কেমন যেন করে উঠত। ছুটকোছাটকা তাদের দু একটাকে দিকভ্রান্ত হয়ে উঠোনেও ঢুকে পড়তে দেখেছি। ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে দূরে কারো ঘরের বিন্দুমাত্র আলোও যদি দেখা যেত, মনে হত নির্ঘাত কোনো অলৌকিক প্রদীপ। কৃষ্ণরাত্রির মেঘ-ক্যানভাসে যখন বাঁশবাগানের মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠতো বজ্রচমক, তখন শব্দব্রহ্মের ভীতিতে চেপে ধরতাম কান। উঠোন লাগোয়া বাঁশঝাড়ের গা ঘেঁষে মজা ডোবায় ব্যাঙেদের উল্লাস কান ঝালাপালা করে দিত। আবার এই বাঁশবাগানেরই শুকনো পাতা কুড়িয়ে আমরা বন্ধুরা মিলে ন্যাড়াপোড়ার আয়োজনে মেতে উঠেছি কত! এখনও সেই গন্ধরাজের জ্যোৎস্না, চৈত্রের হু হু বাতাস, বা প্রজাপতির সন্ধ্যাতারা আঁকা ডানার কালস্রোত পার হয়ে যতই এগিয়ে চলি না কেন সূর্যাস্তের গন্তব্যে, আমার ক্লান্তিময় নির্জন পথও নদীর মতো হয়ে ওঠে, যখন দেখি ওই পাতাঝরা বাঁশবন নিঃশব্দে পিছু নিয়েছে আমার। সঙ্গে রুমঝুম বাজছে জন্মান্তরের স্মৃতি।

আরও পড়ুন
শাচানতলার উপকথা – দ্বিতীয় পর্ব

যখন একটু একটু বড়ো হচ্ছি, ক্লাস এইট বা নাইন, তখন জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ আসন পাততেন সেই ধুলা-অঙ্গনে। আলো-বাতাস আর আনন্দ মাখিয়ে বৈশাখের ২৫শে আমরা আমাদের গলির শেষপ্রান্তে টাঙিয়ে দিতাম হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকা। সুতলিতে ঝুলে থাকত ওয়াটার কালার ধ্যাবড়ানো নদী পাহাড় সূর্য। সেই নদী পাহাড় পেরোতেই বাঁশঝোপের মাঝে চয়ন, ঘোতন, গোরা, অজয়দের সাথে মিলে তক্তপোশ পেতে বানানো হতো স্টেজ। পাড়ার মেয়ে ভজো ভুল করে 'দূর দ্বীপবাসিনী' গেয়ে জিভ কাটত। প্রজেক্টরের আলোয় হেঁটে-চলে বেড়াতেন সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ।

আরও পড়ুন
শাচানতলার উপকথা – প্রথম পর্ব

কোনও এক পঁচিশের এমনই এক কিশোরী-সাঁঝে গ্রিনরুমের সবুজ আবছায়াতে ফোটোফ্রেমের রজনীগন্ধার মালা নিজেদের গলায় বদলাবদলি করে নিয়েছিল পাড়ারই এক প্রেমিক যুগল। মেয়েটির চঞ্চল চুলের ফিতায় টুপটাপ দু-এক ফোঁটা জল ঝরে পড়েছিল তরুণ মেঘের বুক থেকে। বাঁশবন ডিঙিয়ে চক্রবর্তীদের জামরুল গাছের নিচে থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার, মাথার ওপর অযুত নক্ষত্র-মোছা মেঘের আনাগোনা, খসে পড়া শুকনো পাতা ডেকে এনেছিল কালবৈশাখি। তখন দূর রাত্রির দিকে চেয়ে মাতাল ঘূর্ণি উড়ুউড়ু। তখন সমস্ত গান-কবিতা ধুলোমেখে একাকার। তখন দেওয়ালপত্রিকার থেকে গড়িয়ে আসা দোয়াত ওল্টানো কালি আর কুল ছাপানো জলরঙের নদী ছয়লাপ। সব ছাপিয়ে উপচে উপচে উঠতো আমাদের বেদনা। কী জানি কীসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়!

আজ যখন সেই অলীক ভুবনের থেকে কক্ষচ্যুত হয়ে অকারণ জোনাকির ঝিলিমিলির সন্ধানে থাকি, ভাবি আবার জানালার পর্দা তুলে সেই বাশঁবাগান খুঁজব। চারদিকের ইট-বালি-সিমেন্টের ঘেরাটোপ পেরিয়ে দৃষ্টি বেশিদূর এগোবে না জানি। দেখবো, শহরতলি থেকে ধীরে ধীরে শহর হয়ে ওঠার আভিজাত্যে বিলীন এক ধ্বস্ত চরাচর পুড়ে যাচ্ছে বৃক্ষহীনতায়। দেখব, পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির ধার ঘেঁষে দাঁড়ানো যে বয়স্ক আমগাছ আমার অঙ্গনে মুখ বাড়িয়েছিল, তার ঘাড়ে চেপে বসেছে মানুষ। গাছ থেকে তারা একটা একটা করে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, শাখাপ্রশাখা। ঝাপসাবাদল দিনে একাকি মত্ততায় ঝাঁকড়াচুলো খ্যাপা বাউলের মতো আপনছন্দে যে হয়ে উঠত মাতোয়ারা, আজ একটা একটা করে তার পাতা খসে পড়ছে। এভাবে পৃথিবীর সব পাতা একদিন শেষ হয়ে যাবে, সব স্মৃতি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। এক কিশোরের বিগতজীবনের আলোময় চারণভূমি এক বনবাদাড়, তার বুকে আলুথালু নারীর আঁচলের মতো লুটিয়ে থাকা ধুলাপথের আকর্ষণ, কচুগাছ আর আকন্দের ঝোপে ঘেরা এক ভাঙাচোরা সংসারের দৈন্যতা – একদিন হয়তো কিছুই মনে পড়বে না আর। তবুও বাঁশপাতার রিনরিনে আওয়াজ কানে বাজতে থাকবে, বাজতেই থাকবে। সে সুর শুনতে আমি পরজন্ম অবধি বসে রইব জানালার কাছে।

ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতো জেগে রই...

Powered by Froala Editor

More From Author See More