বোর্ডে আটকানো রয়েছে সাদা কাগজ। তুলির আঁচড়ে গোধূলির রং ফুটে উঠছে সেখানে। ফুটে উঠছে দুই মাঝির নৌকা টানার ছবি। ড্রইং কাগজে এই মায়াবি দৃশ্য মুগ্ধ করবে যে কাউকেই। তবে আরও অবাক হতে হবে খোদ শিল্পীকে দেখলে। হাত নয়, বরং মুখ দিয়ে তুলি ধরেই তিনি ফুটিয়ে তুলছেন এই চিত্র। মোহম্মদ আলামিন (Md Alamin)। হুইলচেয়ারে বসে প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে বাংলাদেশের এই চিত্রশিল্পীর এই লড়াই দেখলে শিহরিত হতে বাধ্য যে কেউ।
২০০৮ সালের কথা। তখন কতই বা বয়স তাঁর? ক্লাস এইটের ছাত্র আলামিন। অন্যদিনের মতোই তালগাছে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু নামার সময় বিপত্তি ঘটে যাবে তা আর কে জানত? মুহূর্তের ভুলে গাছ থেকে মাটিতে খসে পড়েন আলামিন। ভেঙে যায় শিরদাঁড়া। হাসপাতালে ভর্তি করার পর প্রাণ বাঁচলেও চিরকালের মতোই চলচ্ছক্তি হারান তিনি। অস্ত্রোপচারের পর পচন ধরে যাওয়ায় কেটে বাদ দিতে হয় একটি পা-ও। কেবলমাত্র ঘাড় থেকে মাথাটুকুই নাড়তে পারেন আলামিন। শরীরের বাকি সমস্ত পেশিকেই অকেজ করে দিয়েছে পক্ষাঘাত।
বলতে গেলে ব্যর্থ হয়েছিল সমস্ত চিকিৎসাই। তারপর, ২০০৯ সালে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারই হয়ে ওঠে তাঁর ঘর। সেখানে গিয়ে যেন নতুন জীবন খুঁজে পান আলামিন। কৈশোরের নেশা ছবি আঁকাকেই আঁকড়ে ধরে তিনি। তবে খুব একটা সহজ ছিল না সেই পথ। হাতের বদলে ঠোঁটের মাধ্যমে পেন-পেনসিল ধরা কি সহজ কথা? তবে হতোদ্যম হননি তিনি। বরং, জেদ এবং একাগ্রতাকে হাতিয়ার করে সম্ভব করে দেখিয়েছেন অসম্ভবকে। তাঁর শিল্পীপ্রতিভা রীতিমতো চমকে দিয়েছিল রিহ্যাব সেন্টার কর্তৃপক্ষকেও।
২০১৪ সালে প্রথমবারের জন্য তাঁর আঁকা ছবি বিক্রি হয় সংশ্লিষ্ট রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের মারফতেই। তারপর ক্রমশ ছড়িয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা। এখনও পর্যন্ত পেশাদার শিল্পী হিসাবে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশোরও বেশি ছবি এঁকেছেন আলামিন। রিহ্যাব সেন্টার থেকে তাঁর কাছে ছবির অর্ডার আসে ধারাবাহিকভাবেই। কখনো কখনো আবার বিদেশ থেকেও। তবে মুখ দিয়ে ছবি আঁকা সময়সাপেক্ষ হওয়ায়, এক একটি ছবি শেষ করতে প্রায় এক থেকে দু’দিন সময় লেগে যায় আলামিনের। সাধারণত, প্রকৃতির ছবিই আঁকতে ভালোবাসেন আলামিন। তাছাড়াও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ীও নানান ছবি এঁকে দেন বাংলাদেশের তরুণ শিল্পী। তাতে গড়ে প্রতি মাসে হাজার দশেক টাকা হাতে আসে। চিকিৎসার খরচ চালানো ছাড়াও, কিছুটা হলেও সাহায্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় পরিবারের কাছে।
আরও পড়ুন
শিল্পীদের তুলিতে পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রদর্শনী মার্কিন রেস্তোরাঁয়
তবে সাম্প্রতিক সময়ে মহামারীর প্রকোপে ধাক্কা খেয়েছে তাঁর আর্থিক অবস্থাও। অনেকটাই কমে গেছে অর্ডারের পরিমাণ। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি সরকারও। তবুও এই লড়াই ছাড়তে নারাজ আলামিন। তাঁর এই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই-ই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে হাজার হাজার প্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীদের…
আরও পড়ুন
শিল্পী হরেন দাসের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দক্ষিণ কলকাতায়
তথ্যসূত্রঃ হাত-পা প্যারালাইজড, তবু মুখ দিয়ে ছবি এঁকে চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছেন আলামিন, বিবিসি বাংলা
আরও পড়ুন
৩০ বছর ধরে আঁকা ছবি, অবশেষে প্রকাশ্যে শিল্পীর সৃষ্টি
Powered by Froala Editor